—ডেল কার্নেগি
০১. আজকের জন্য বেঁচে থাকুন
১৮৭১ সালের বসন্তকালে এক তরুণ একখানা বইয়ের একুশটি কথা পড়ে গেলেন, কথাগুলো তার ভবিষ্যৎ জীবনে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। মন্ট্রিল জেনারেল হাসপাতালের এক ডাক্তারী ছাত্র ছিলেন তিনি। শেষ পরীক্ষায় পাশকরা, ভবিষ্যতে কোথায় যাবেন, কি করবেন, ডাক্তারি পসার কেমন হবে কিভাবে জীবিকা অর্জন করবেন এইসব নিয়ে তিনি খুবই চিন্তায় পড়েছিলেন।
১৮৭১ সালে যে কথাগুলো ঐ তরুণ ডাক্তার ছাত্রটি পড়েছিলেন তারই সাহায্যে তিনি হয়েছিলেন তার কালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসক। তিনি বিশ্ববিখ্যাত ‘জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিন’ পরিচালনা করেন। তিনি অক্সফোর্ডের রেজিয়াস অধ্যাপক নিযুক্ত হন–এটা ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোন চিকিৎসককে দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান। ইংলণ্ডের রাজা তাকে নাইট উপাধি দেন। মৃত্যুর পর তার জীবনী প্রকাশের জন্য দুটো বিরাট বইয়ে ১৪৬৬খানা পাতা লেগেছিল।
ওই চিকিৎসক হলেন স্যার উইলিয়ম অসলার। ১৮৭১ সালের বসন্তকালে যে কথাগুলো তিনি পড়েছিলেন তা এই টমাস কার্লাইলের লেখা একুশটা কথা : অস্পষ্টতায় ভরা দূরের কিছুর চেয়ে কাছের স্পষ্ট কিছু দেখাই আমাদের দরকার।
বিয়াল্লিশ বছর পরে এক নরম বসন্তের রাতে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউলিপ ফুলে ভরা আঙিনায় স্যার উইলিয়াম অসলার ছাত্রদের সামনে একটা ভাষণ দেন। তিনি বলেন তার মত একজন মানুষ, যিনি চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর জনপ্রিয় কোনো বই লিখেছেন, তার অবশ্যই বিশেষ ধরনের গুণ মস্তিষ্কে থাকবে। তিনি বলেন কথাটা একদম অসত্য, কারণ তার বন্ধুরা জানেন তার মস্তিষ্ক অতি সাধারণ।
তাহলে তার এই সাফল্যের গোপন রহস্য কি? তিনি বলেছিলেন, সেটা হল তার কথা অনুযায়ী দৈনিক জীবন যাপনের ফল। কথাটার অর্থ কি? এই বক্তৃতা দেওয়ার কয়েক মাস আগে স্যার অসলার বিরাট এক যাত্রীবাহী জাহাজে আটলান্টিক পার হন। জাহাজের ক্যাপ্টেন সেখানে একটা বোতাম টিপতেই আশ্চর্য এক কাণ্ড ঘটে–কিছু যন্ত্রপাতির শব্দ জেগে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের প্রতিটি অংশ একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যায়। ডঃ অসলার ছাত্রদের এবার বললেন, তোমরা ওই চমৎকার জাহাজের চেয়েও অনেক বেশী আশ্চর্যজনক ভাবে তৈরি এবং ভবিষ্যতে অনেক দূর তোমাদের যেতে হবে। আমি যা বলতে চাই তা হলো তোমাদের সব যন্ত্রপাতি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করো যাতে দৈনিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হও–এতেই নিরাপদে যাত্রা পথে চলতে পারবে। পাটাতনে দাঁড়িয়ে দেখে নাও বেশিরভাগ যন্ত্র সচল আছে কিনা। আর একটা বোতাম টেপা আর শুনে নাও তোমাদের জীবনের লোহার দরজাগুলো অতীতকে তোমাদের জীবনে রুদ্ধ করতে পারছে কিনা। আর একটা বোতাম টিপে বন্ধ করে দাও নবাগত ভবিষ্যৎকে। তাহলেই তোমরা নিরাপদ–আজকের মত নিরাপদ! অতীতকে রুদ্ধ করো! অতীতকে সমাধিতে দাও …অতীতের কথা ভেবে অনেক মূর্খই মরেছে…. ভবিষ্যতের ভারের সঙ্গে অতীতের বোঝা যুক্ত হয়ে আজকের বোঝা সবচেয়ে বড় হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎকে অতীতের মতই বন্ধ করে দাও …. ভবিষ্যৎ হলো আজ… আগামীকাল বলে কিছুই নেই। মানুষের মুক্তির দিন হলো আজ। মানুষ ভবিষ্যতের কথা ভেবে শক্তিহীনতা, মানসিক দুশ্চিন্তা আর স্নায়ুর দুর্বলতায় ভোগে। অতএব অতীত আর ভবিষ্যৎকে অর্গলরুদ্ধ করে রোজকার জীবন নিয়েই বাঁচতে চেষ্টা করো। ডঃ অসলার কি তবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি থাকতে বারণ করেছেন? না, কখনই না। তবে ঐ ভাষণে তিনি বলেছিলেন ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হওয়ার সব সেরা পথ হলো সমস্ত বুদ্ধি, ক্ষমতা আর আগ্রহ দিয়ে আজকের কাজ করে যাওয়া।
স্যার উইলিয়াম অসলার ইয়েলের ছাত্রদের খৃষ্টের এই প্রার্থনা দিয়ে দিন শুরু করতে বলেছিলেন: প্রভু, আজ আমাদের আজকের রুটি দাও। মনে রাখবেন প্রার্থনায় কেবল আজকের রুটির কথাই প্রার্থনাকারী বলছে। গতকালের বাসি রুটি খাওয়ার জন্য কোন অভিযোগ জানায় নি সে। প্রার্থনায় সে বলেনি, হে প্রভু, গম চাষের জমি খরা কবলিত–আর আবার খরা হতে পারে–আগামী শীতে তাহলে কিভাবে খাওয়া জুটবে–বা আমার যদি চাকরি না থাকে–ও ঈশ্বর তাহলে কীভাবে রুটি জুটবে?
না, ওই প্রার্থনায় খালি আজকের রুটির কথাই আছে। সম্ভবত আজকের রুটিই শুধু আপনারা খেতে পারেন।
বহু বছর আগে এক কপর্দকহীন দার্শনিক এক কঙ্করময় দেশে ভ্রমণ করছিলেন, যে দেশের লোকেরা সকলেই দরিদ্র। একদিন এক পাহাড়ে, তার পাশে কিছু লোক জমায়েত হলে তিনি যা বললেন সেটাই আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি উদ্ধত বাণী। ছাব্বিশ শব্দের ওই বাণী শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে অনুরণিত: আগামীর চিন্তা ত্যাগ কর, কারণ আগামীকালই তার ভার নেবে। আজকের দিনেই ত্যাগ কর, কারণ আগামীকালই তার ভার নেবে। আজকের দিনেই করণীয় অনেক আছে।
অনেকেই যীশুর সেই বাণী, ‘কালকের কথা চিন্তা কর না’ মেনে নেয় নি। তাদের বক্তব্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পক্ষে ওকালতি, যেটা প্রাচ্যের কিছু রহস্যময়তা। তাদের কথা হল, আমায় কালকের কথা ভাবতেই হবে। আমার পরিবারের জন্য বীমা করতেই হবে, বৃদ্ধবয়সের জন্যও টাকা চাই। উন্নতির জন্য আমায় চেষ্টা করতেই হবে।
ঠিক। এসব তো করা চাইই। আসল কথাটা হলো খ্রিস্টের ওই বাণী প্রায় তিনশ বছর আগে অনুদিত রাজা জেমসের রাজত্বের সময় তার যা মানে ছিল আজ আর তা নেই। তিনশ বছর আগে ‘চিন্তা’ কথাটার অর্থ ছিল দুশ্চিন্তা। বাইবেলের আধুনিক সংস্করণে যীশুর বাণী আরও প্রাঞ্জল করে বলা হয়েছে : আগামীকালের জন্য দুশ্চিন্তা কোর না।