গ্যালেন লিচফিল্ডের কথাই ধরা যাক। ভদ্রলোককে বহুবছর ধরে চিনি–প্রাচ্যদেশে সবচেয়ে সফল আমেরিকান ব্যবসায়ী তিনি। মিঃ লিচফিল্ড ১৯৪২ সালে চীনে ছিলেন, সে সময় জাপানীরা সাংহাই আক্রমণ করে। আমার বাড়ির অতিথি হয়ে উনি যা বলেন তা এই
জাপানিরা পার্ল হারবার আক্রমণ করার কিছু পরে, তারা সাংহাইতে তরতর করে ঢুকে পড়ে। আমি সাংহাইতে এশিয়া জীবন বীমা কোম্পানীর ম্যানেজার ছিলাম। তারা ব্যবসা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য একজনকে পাঠাল–লোকটা একজন অ্যাডমিরাল । এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছুই ছিল না। আমি সহযোগিতা করতে পারলে ভালো, না হলে নিশ্চিত মৃত্যু।
আমাকে যাই বলা হলো তাই করে গেলাম, কারণ অন্য পথ ছিলো না। তবে কিছু দলিল ছিলো যার মূল্য সাড়ে সাতলক্ষ ডলার। অ্যাডমিরালকে সেটা না দিয়ে চেপে গেলাম। কারণ সেটা ছিলো আমাদের হংকং ব্যাঙ্কের হিসেব, সাংহাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন। তাহলেও ভয় হলো জাপানীরা টের পেলে ভয়ানক বিপদ হবে। তারা টের পেয়েও গেল।
যখন ওরা জানতে পারলো আমি তখন অফিসে ছিলাম না। তখন আমার হেড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। তিনি জানালেন জাপানি অ্যাডমিরাল ক্ষেপে আগুন, আমাকে তিনি চোর, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি বলে গালাগাল দেন। আমি জাপানি সেনাদের আগ্রাহ্য করেছি–এর ফল কি হতে পারে তা আমার জানা ছিলো। আমাকে ব্রিজ হাউসে পাঠানো হবে।
ব্রিজহাউস হলো জাপানি গুপ্ত পুলিশের অত্যাচার কক্ষ। আমার কিছু বন্ধু ওখানে পাঠানোর আগেই আত্মহত্যা করে। আমার অন্য বন্ধু প্রশ্ন আর অত্যাচারের দশদিন পর ওখানে মারা যায়। এবার আমাকেই পাঠানো হবে।
আমি কী করলাম? আমি রবিবার বিকেলে খবরটা শুনি। ভয়ে আমার নীল হয়ে ওঠা উচিত ছিল। হতাম ও তাই, যদি না আমার সমস্যা সমাধানের নিজস্ব কায়দা থাকতো। বহু বছর ধরে সমস্যা এলেই টাইপ রাইটারে দুটো প্রশ্ন লিখে ফেলতাম :
১। কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি?
আমার ভয় হচ্ছে আমাকে কাল সকালে ব্রিজহাউসে পাঠানো হবে।
২। এটা নিয়ে কি করতে পারি?
অনেকক্ষণ ভেবে চারটি পথ গ্রহণ করার কথা ভাবলাম–আর তার সম্ভাব্য পথ।
১। আমি জাপানী অ্যাডমিরালকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু তিনি ইংরাজী জানেন না। দোভাষীর সাহায্যে চেষ্টা করলে তিনি ক্ষেপে যেতে পারেন। লোকটি নিষ্ঠুর হলে এতে মৃত্যু ঘটতে পারে। তিনি আমাকে হয়তো ব্রিজহাউসেই পাঠাবেন।
২। আমি পালানোর চেষ্টা করতে পারি। সেটা অসম্ভব। তারা সবসময় আমার উপর নজর রাখছে। পালাতে গেলেই ধরা পড়ে গুলি করা হবে।
৩। আমার ঘরেই বসে থেকে অফিসে না যেতে পারি। এটা করলে ওই জাপ অ্যাডমিরালের সন্দেহ হবে আর ধরে এনে আমায় ব্রিজহাউসে পাঠানো হবে।
৪। সোমবারে সকালে যথারীতি অফিস যেতে পারি। এটা করলে অ্যাডমিরাল এত ব্যস্ত থাকতে পারেন যে আমি কি করেছি তার মনে থাকবে না। মনে থাকলেও ঠাণ্ডা হওয়ায় হয়তো কিছু বলবেন না । এটা হলে আমার ভয় নেই। কিছু বললে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে পারি। অতএব সোমবার সকালে যথারীতি অফিসে গেলে ব্রিজহাউসে যাওয়া থেকে বাচার দুটো সুযোগ আছে। যখনই ঠিক করলাম সোমবার অফিসে যাব, অনেকখানি দুশ্চিন্তাই আমার কেটে গেল।
পরদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই জাপানী অ্যাডমিরালকে ঠোঁটে সিগারেট লাগিয়ে বসে থাকতে দেখলাম। তিনি বরাবরের মত চড়া চোখে তাকালেন, কিছু বললেন না। দু’সপ্তাহ পরে–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ–তিনি টোকিও ফিরে গেলেন আর আমারও দুশ্চিন্তার অবসান হলো।
যা বলেছি, রবিবার বিকেলে বসে কি কি পথ নেওয়া উচিত লিখে ফেলার ফলেই সম্ভবতঃ আমার, জীবন রক্ষা হয়। এটা যদি না করতাম হয়তো ইতস্তত করতাম আর আচমকা ভুল কাজ করতাম–সারা রাত ঘুমোতে পারতাম না। পরদিন অফিসে ক্লান্তভঙ্গীতে গেলেই লোকটার সন্দেহ জাগতো। ১. অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছবার মূল্য কি আমি জানি। এটা যারা পারেন না তাদেরই বিপদ হয়, তারাই স্নায়বিক বিকারে ভুগে জীবিত অবস্থায় নরকবাস করেন। আমি দেখেছি কোন সিদ্ধান্তে এলেই আমার শতকরা পঞ্চাশভাগ দুশ্চিন্তা কেটে যায়, আর বাকি চল্লিশভাগও দূর হয় সিদ্ধান্ত কাজে লাগালে।
অতএব আমি শতকরা নব্বই ভাগ দুশ্চিন্তাই নিচের চারটি উপায় কাজে লাগিয়ে দূর করতে পারি :
১। পরিষ্কার লিখে ফেলা কিজন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
২। কি করতে পারি তা লিখে ফেলা।
৩। কি করবো ঠিক করে ফেলা।
৪। সিদ্ধান্তটি সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগানো।
গ্যালেন লিচফিল্ড বর্তমানে স্টার, পার্ক ও ফ্রিম্যান কোম্পানীর প্রাচ্যের ডিরেক্টর। তিনি এশিয়াতে একজন বিশিষ্ট আমেরিকান ব্যবসায়ী। তিনি আমার কাছে স্বীকার করেছেন তার সব সাফল্যের মূল হল দুশ্চিন্তা বিশ্লেষণ করে সোজাসুজি তার মুখোমুখি হওয়া।
এই পদ্ধতি এত কাজের কেন? কারণ এটি চমৎকার আর সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে। এর উপর এটি সেই চরম আর তৃতীয় নিয়ম কাজে লাগায়, কিছু একটা করুন। কিছু না করার অর্থ তথ্য সংগ্রহের সব পরিশ্রমই যে ব্যর্থ হয়।
উইলিয়াম জেমস বলেছিলেন, কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছলে তাকে কাজে লাগানোর পর এর ফলের জন্য দায়িত্ব আর চিন্তা ত্যাগ করবেন (চিন্তা কথাটি তিনি দুশ্চিন্তা অর্থেই ব্যবহার করেন)। তার কথা হলো–তথ্যে নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্তে এলে কাজে নেমে পড়ুন। কখনই পুনর্বিবেচনা করবেন না, ইতস্তত করবেন না, আত্মসন্দেহে দোদুল্যমান হবেন না তাতে অন্য সন্দেহ জাগে। পিছনে তাকাবেন না।