দুশ্চিন্তা মানুষের কী ক্ষতি করতে পারে জানার জন্য আমাকে লাইব্রেরিতে বা ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না। এই বই লেখার সময় জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাই একটা বাড়িতে একজন স্নায়বিক অবসাদে ভেঙ্গে পড়েছেন–আর অন্য একটা বাড়িতে অপরজনের ডায়াবেটিস হয়েছে। শেয়ার বাজার পড়ে যাওয়াতেই তার রক্ত আর প্রস্রাবে সুগার বেড়ে যায়।
বিখ্যাত ফরাসী দার্শনিক মন্টেইন–কে তার নিজের শহর বোর্দোর মেয়র নির্বাচিত করা হলে তিনি নাগরিকদের বলেন: আপনাদের সব কাজের দায়িত্ব আমার হাতে নিতে পারি তবে আমার লিভার আর পাকস্থলীতে নয়।
আমার ওই প্রতিবেশী শেয়ার মার্কেটের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করেই প্রায় মরতে বসেছিলেন।
দুশ্চিন্তার কুফল নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমাকে অবশ্য প্রতিবেশীর দিকে তাকানোরও দরকার হয় না কারণ আমার এই ঘরেই তার প্রমাণ আছে। এ বাড়ির পূর্বতন মালিকও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে অকালে মারা যান ।
বিশ্বের অন্যতম গেঁটে বাত–বিশেষজ্ঞ ড. রাসেল ডি. মিসিল বলেছেন দুশ্চিন্তা মানুষকে বাতে পঙ্গু করে হুইল চেয়ারে বসাতে পারে। তার মতে গেঁটে বাত হওয়ার প্রধান চারটি কারণ হল :
১ বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য।
২ অর্থনৈতিক বিপর্যয় আর দুঃখ ।
৩ নিঃসঙ্গতা আর দুশ্চিন্তা।
৪ বহুঁকাল পুষে রাখা অসন্তোষ।
এই কারণগুলো অবশ্যই আবেগজনিত আরও ঢের কারণে গেঁটে বাত হতে পারে। তবে সাধারণ কারণ বলতে ওই দুশ্চিন্তাই আছে। উদাহরণ হিসেবে বলছি, আমার এক বন্ধুর আর্থিক দুরবস্থার সময় গ্যাস কোম্পানী গ্যাস বন্ধ করে দেয়। ব্যাঙ্ক ও বাড়ির মর্টগেজ রদ করে দেয়। এই সময় তার স্ত্রীর গেটে বাত জন্মায়–আর যতদিন না তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো হয় ততদিন রোগ সারেনি।
দুশ্চিন্তায় দাঁতেরও ক্ষয় হয়। ডঃ উইলিয়াম আই.এল. ম্যাকগনিগল বলেন, অসুখী মনোভাব যদি দুশ্চিন্তা, ভয় ঘ্যানঘ্যানানি থেকে জন্মায় তা শরীরের ক্যালসিয়াম নষ্ট করে দিতে পারে আর তাতেই দাঁতে ক্ষয় হয়। তিনি এক রোগীর কথা বলেছেন যার চমৎকার দাঁত ছিলো কিন্তু তার স্ত্রীর অসুস্থতার চিন্তায় প্রায় নটি দাঁতে গর্ত হয়ে যায়। সবটাই ওই দুশ্চিন্তার জন্য।
এমন কাউকে দেখেছেন যার থাইরয়েড গ্রন্থি অতি চঞ্চল? আমি দেখেছি, তারা থর থর করে কাঁপে–তারা যেন মৃত্যুভয়ে সবসময়েই ভীত। থাইরয়েড গ্ল্যান্ড যা শরীর নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের এমন অবস্থায় এনে ফেলে যে, হার্টের গতি বৃদ্ধি হয়–সারা দেহ যেন চুল্লির আগুনে হাওয়া পেয়ে জোরে চলতে থাকে। আর এটা বন্ধ না করতে পারলে, অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা না করলে এঁরা মৃত্যুবরণ করতে পারে।
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে ফিলাডেলফিয়ায় গিয়েছিলাম, তার এই রোগ ছিল। তাকে এক বিখ্যাত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই, তিনি আটত্রিশ বছর এই রোগের চিকিৎসা করছেন। তার বৈঠকখানার দেয়ালে ফ্রেমে আঁটা একটা উপদেশ ছিলো। আমি সেটা টুকে নিই। সেটা এই রকম :
সবচেয়ে আরামপ্রদ অবসর বিনোদনের শক্তি হলো সুস্থধর্ম, ঘুম, সঙ্গীত আর হাসি । ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখুন–ভালোভাবে ঘুমোতে শিখুন–সঙ্গীতকে ভালোবাসুন আর জীবনের মজার দিকটি দেখার চেষ্টা করুন। তাহলেই সুস্বাস্থ্য আর সুখ আপনার আয়ত্ত হবে।
***
আমার ঐ বন্ধুকে ডাক্তার প্রথমেই এই প্রশ্ন করেন: আপনার কি কোন মানসিক আবেগের ফলে এমন অবস্থা হয়েছে। তিনি আমার বন্ধুকে সাবধান করে বলেন তিনি যদি দুশ্চিন্তা দূর না করেন তাহলে অন্য উপসর্গ যেমন–হৃদরোগ, আলসার বা বহুমূত্র ইত্যাদি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। ডাক্তার জানান, এই সব রোগ খুড়তুতো, জ্যেঠতুতো ভাইয়ের মতই–এর সবই দুশ্চিন্তার রোগ!
আমি যখন প্রথম মার্লে ওবেরনের সাক্ষাৎকার নিই তিনি আমাকে জানান তিনি কিছুতেই দুশ্চিন্তা করেন না। কারণ তার জানা ছিলো দুশ্চিন্তা সিনেমার পর্দায় তার প্রধান আকর্ষণই নষ্ট করে দেবে।
তিনি আমায় বলেছিলেন : প্রথম যখন সিনেমায় নামতে যাই দুশ্চিন্তা আর ভয়ে কাঠ হয়েছিলাম। আমি সাবে ভারতবর্ষ থেকে এসেছি আর লন্ডনে কাউকে চিনতাম না সেখানে একটা কাজ চাইছিলাম। যখন প্রযোজকের সঙ্গে দেখা করি, কিন্তু কেউ আমায় নিলেন না, আমার সামান্য পুঁজি ফুরিয়ে আসছিল। দু’সপ্তাহ ধরে আমি শুধু বিস্কুট আর জল খেয়ে কাটাই। তখন দুশ্চিন্তা ছাড়াও আমার খিদের জ্বালাও জটলো৷ নিজেকে তাই বললাম, হয়তো তুমি একটি বোকা–হয়তো কোনদিনই ছবির জগতে ঢুকতে পারবে না। তোমার কোন অভিজ্ঞতা নেই। জীবনে কখনো অভিনয় করোনি–তোমার সুন্দর মুখোনা, ছাড়া আর কি দেখার আছে?
আমি আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। যখন আয়নায় তাকালাম দেখলাম দুশ্চিন্তা আমার মুখের কি দশা করেছে, কালো রেখা পড়েছে সেখানে। উদ্বেগের চিহ্ন ও চোখে পড়ল। তাই নিজেকে বললাম : এটা এখনই বন্ধ করা চাই। তোমার দুশ্চিন্তা করা একেবারে চলবে না। দেবার মত তোমার ওই সৌন্দর্যই আছে, তাকে নষ্ট করা চলবে না।
মেয়েদের চেহারা সবচেয়ে খারাপ হয়ে যায় দুশ্চিন্তায়। দুশ্চিন্তা নিজেকে প্রকাশে বাধা দেয়। চুলে পাক ধরতে পারে, তা উঠেও যেতে পারে, চামড়ার রোগ হতে পারে।
আমেরিকায় হৃদরোগেই আজকাল সবচেয়ে বেশি লোক মারা যায়। দ্বিতায় বিশ্বযুদ্ধে এম সাতলক্ষ লোক মারা যায়। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে বিশ লক্ষ লোক মারা যায় হৃদরোগে–এর অর্ধেক আবার এমন হৃদরোগ, যার উৎপত্তি হয় দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে জীবন যাপনের জন্য। হ্যাঁ, এই কারণেই ডঃ অ্যালেক্সিস বলেছিলেন, যে সমস্ত ব্যবসায়ীরা জানেন না দুশ্চিন্তা কিভাবে দূর করতে হয় তাদের অল্পবয়সে মৃত্যু হয়।