সিগারেটের কথায় মনে পড়ছে সম্প্রতি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত সিগারেট কোম্পানীর প্রস্তুতকারক কানাডিয় জঙ্গলে ছুটি কাটাতে গিয়ে হৃদরোগে মারা যান। তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন আর একষট্টি বছর বয়সে মারা গেলেন। ব্যবসাতে সাফল্য আনতে গিয়ে তিনি বোধহয় জীবনের সেরা অংশই ব্যয় করেছিলেন।
.
আমার মতে সিগারেট কোম্পানির ওই মালিক আমার বাবার তুলনায় অর্ধেকও জীবনে সফল হননি। মিসৌরীর চাষী, আমার বাবা বেঁচেছিলেন ৮৯ বছর আর এক কপর্দকও মৃত্যুর সময় রেখে যাননি।
বিখ্যাত মেয়ো ভাইয়েরা বলেছেন আমাদের হাসপাতালের অর্ধেকেরও বেশি রোগী হলেন স্নায়ুর রোগী। তবুও এইসব স্নায়ু রোগীরা মারা যাওয়ার পর অণুবীক্ষণ যন্ত্রে পরীক্ষার পর দেখা যায় তাদের স্নায়ু ম্যাক ডেম্পসীর চেয়েও সবল ছিল। তাদের স্নায়ুর গোলযোগ ঘটে শারীরিক কারণে নয় বরং ব্যর্থতা, পরাজিতের মনোভাব, উদ্বেগ, ভয়, দুশ্চিন্তা এবং হতাশা থেকে। প্লেটো বলেছিলেন, চিকিৎসকরা যে ভুল করেন তা হলো তারা মনের চিকিৎসা না করে শরীর সারাতে চান, যদিও মন আর শরীর অবিচ্ছেদ্য তাই আলাদা করে চিকিৎসা উচিত নয়।
এই মহাসত্য বুঝতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের লেগেছিল তেইশশো বছর। আমরা এখন এক নতুন ধরনের ওষুধ তৈরির চেষ্টা করছি যার নাম সাইকোসোমাটিক ওষুধ–যে ওষুধ মন ও শরীরের একসঙ্গে চিকিৎসা করবে। আমাদের এটা করার উপযুক্ত সময় কারণ চিকিৎসা বিজ্ঞান ইতিমধ্যেই সাংঘাতিক সব রোগ–যেমন বসন্ত, কলেরা, ইয়োলোফিভারের মতো রোগ নির্মূল করতে পেরেছে, যে রোগে কোটি কোটি মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান উদ্বেগ, ভয়, ঘৃণা, হতাশা ইত্যাদিতে যে মন ও শরীর ভেঙে যায় তা রোধ করতে পারেনি। এই জাতীয় রোগ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে।
ডাক্তারদের মত হল প্রতি বিশজনে একজন আমেরিকান তার জীবনের একাংশ কোন না কোন সময় মানসিক হাসপাতালে কাটাতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেনাদলে যোগ দিতে যেসব যুবক আসে তাদের প্রতি ছ’জনের মধ্যে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত বলে ভর্তি নেয়া হয়নি।
লোকে উন্মাদ হয় কেন? এর সব উত্তর কেউ জানেন না। তবে এটা খুবই সম্ভব যে অনেক ক্ষেত্রেই ভয় আর উদ্বেগ এজন্য দায়ী। দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগে যে হতাশাগ্রস্ত হয়, নিজেরাই এক স্বপ্নের জগৎ গড়ে নেয় আর সেইভাবেই তারা দুশ্চিন্তা কাটায়।
লেখার অবসরে দেখছি আমার সামনে একখানা বই রয়েছে। বইখানা ডঃ এডওয়ার্ড পোলস্কির লেখা, নাম ‘দুশ্চিন্তা কাটিয়ে নিরাময় হোন।’ বইয়ের কিছু পরিচ্ছদের নাম এইরকম:
দুশ্চিন্তা হৃদয়ের কী করে?
দুশ্চিন্তায় রক্ত চাপ বাড়ে।
দুশ্চিন্তায় বাত হতে পারে।
পাকস্থলীর জন্যই দুশ্চিন্তা কম করুন।
দুশ্চিন্তায় কিভাবে সর্দিকাশি হয়?
দুশ্চিন্তা ও থাইরয়েড গ্রন্থি।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বহুমূত্ররোগী।
দুশ্চিন্তা সম্পর্কে আর একখানা চমৎকার বই হলো ডঃ কার্ল মেনিনজারের ‘নিজের বিরুদ্ধে মানুষ’। তার বইতে দুশ্চিন্তা দূর করার কোন পরামর্শ নেই তবে এতে পাবেন আমরা কিভাবে আমাদের স্বাস্থ্য আর মন, উদ্বেগ হাতাশা ঘৃণা, তিক্ততা, ভয় ইত্যাদিতে সমস্ত নষ্ট করে ফেলি তারই অভাবিত সব দৃষ্টান্ত।
দুশ্চিন্তা কঠিন ধাতের মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে জেনারেল গ্র্যান্ট সেটা বুঝেছিলেন। কাহিনীটি এই রকম: গ্র্যান্ট ন’ মাস যাবৎ রিচমন অবরোধ করেছিলেন। জেনারেল লী’র সেনাদল ক্ষুধা–তৃষ্ণায় চরম দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পরাজিত। সমস্ত রেজিমেন্ট পালাতে ব্যস্ত। বাকিরা তাবুতে বসে আর্তনাদ করছিল আর কাঁদছিল কেউ বা প্রার্থনায় রত। শেষের আর দেরি ছিলো না। লী’র সেনারা রিচমণ্ডের অস্ত্রের গুদাম, তুলো আর তামাকের গুদামে আগুন লাগানোয় সারা রিচমণ্ড যেন জ্বলছিল। তারা রাতের অন্ধকারে পালায়। গ্র্যান্ট চারদিক থেকে তেজের সঙ্গে তাড়া করে চলেছিলেন কনফেডারেট সেনাদের। সেই সময় শেরিডানের অশ্বারোহী বাহিনী সামনে রেল লাইন উপড়ে ফেলে সরবরাহের গাড়ি অধিকার করেছিলেন।
গ্র্যান্ট প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণায় প্রায় অন্ধ হয়ে পিছিয়ে পড়ে একটা খামারবাড়িতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তিনি তার স্মৃতিকথায় বলেছেন, আমি সারা রাত গরম জলে পা ডুবিয়ে ঘাড়ে আর হাতের কব্জিতে সরষের তেল মেখে সকালে সুস্থ হব ভেবে কাটালাম।
পরদিন সকালে তিনি চট করেই সেরে উঠলেন। আর তাকে যা সরিয়ে তুললো তা কিন্তু সরষের তেলের পুলটিস নয়, একজন অশ্বারোহী লী’ আত্মসমর্পণ করতে চান লেখা একটা চিঠি আনার ফলে।
অফিসারটি চিঠিসহ আমার কাছে আসার সময়েও, গ্র্যান্ট লিখেছেন, আমার অসহ্য মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিলো। কিন্তু যে মুহূর্তে চিঠির বক্তব্য দেখলাম আমি ভালো হয়ে গেলাম।
বোঝা যাচ্ছে গ্ল্যান্টের দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর আবেগই তাকে অসুস্থ করে তুলেছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে তার সব আবেগ আত্মবিশ্বাস, সমাধা এবং জয় এনে দিলো তখনই তিনি সেরে উঠলেন।
এর ঠিক সত্তর বছর পরে ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের ক্যাবিনেটের ট্রেজারী সেক্রেটারী হেনরি মর্গেনথাউ জুনিয়র আবিষ্কার করেন যে, দুশ্চিন্তা তাকে এতই অসুস্থ করেছে যে তার মাথা ঘুরতে থাকে। তিনি তাঁর ডায়েরীতে লিখেছিলেন যে তার অসম্ভব দুশ্চিন্তা হয় প্রেসিডেন্ট যখন গমের দাম বাড়ানোর জন্য একদিনে চুয়াল্লিশ লক্ষ বুশেল গম কেনেন। তিনি ডায়েরিতে লেখেন, ব্যাপারটা যখন চলছিল তখন সত্যিই আমার মাথা ঘুরছিল। বাড়ি ফিরে আমি দুঘণ্টা ঘুমোই।