অতএব আপনি যদি চান লোকে আপনাকে পছন্দ করুক, তাহলে তিন নম্বর নিয়ম হলো : মনে রাখবেন কোন মানুষের কাছে তার নিজের নামই হলো সব ভাষাতেই সব চেয়ে মিষ্টি।
০৭. ভালো বক্তা হওয়া যায় কী করে
সপ্তম পরিচ্ছেদ
ভালো বক্তা হওয়া যায় কী করে
সম্প্রতি আমি এক ব্রিজ খেলায় আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবে আমি ব্রীজ খেলি না, সেখানে স্বর্ণকেশী একটি মেয়েও ছিল যে ব্রিজ খেলে না। সে জানতো লাওয়েল টমাস রেডিওয় যোগ দেবার আগে আমি তার ম্যানেজার ছিলাম। সে আরও জানতো আমি তার সঙ্গে ইউরোপ ভালোভাবে ঘুরেছি আর তার বক্তৃতাও বানিয়ে দিয়েছি। মেয়েটি তাই বললো : ‘ওহ, মিঃ কার্নেগী, আপনার দেখা সব জায়গা আর সুন্দর দৃশ্যগুলোর কথা আমাকে বলুন।’
‘আমরা সোফায় বসার পর সে জানালো স্বামীর সঙ্গে ও ইদানীং আফ্রিকা ভ্রমণ করে এসেছে। ‘আফ্রিকা!’ আমি প্রশংসা করে বলে উঠলাম। কী চমৎকার! আমি নিজেও আফ্রিকায় বেড়াতে চেয়েছি, কিন্তু একবার কেবল আলজিয়ার্সে চব্বিশ ঘন্টা থাকা ছাড়া আর যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। তোমরা
সেখানে বড় শিকারের এলাকায় গিয়েছো নাকি? গেছো! বাঃ! দারুণ! কি সৌভাগ্য। তোমাকে দেখে হিংসে হচ্ছে আমার। তোমার আফ্রিকার গল্প শোনাও।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট মেয়েটি ওর কাহিনী শুনিয়ে গেল। সে আর একবারও জানতে চাইলো না আমি কোথায় গিয়েছি বা দেখেছি। সে আমার বেড়ানোর গল্প আর শুনতে চায়নি। সে যা চাইছিলো তা হলো একজন আগ্রহী শ্রোতা। যাতে সে কোথায় গিয়েছিল শুনিয়ে আত্মগর্বে ফুলে উঠতে পারে।
মেয়েটি কি অস্বাভাবিক কিছু? মোটেই না। অনেকেই এই রকম।
যেমন একটা উদাহরণ দিচ্ছি, সম্প্রতি আমি নিউইয়র্কের প্রকাশক কে. ডব্লিউ গ্রীণবর্ণের দেওয়া এক ডিনার পার্টিতে একজন বিখ্যাত বোটানিস্টের সঙ্গে সাক্ষাত করি। কোন বোটানিস্টের সঙ্গে আগে আমার আলাপ হয়নি। তাই তাকে আমার দারুণ মনে হলো। আমি চেয়ারের প্রায় হাতলে কোন রকমে বসেই তার কথা গিলছিলাম। তিনি নানা রকম বিষয়ে তাঁর কথা শোনালেন। গাঁজা, সাধারণ আলু, ইত্যাদি সম্পর্কে তিনি আশ্চর্য সব কথা শোনালেন। আমার নিজের একটা ছোট্ট বাগান আছে–তিনি আমায় সে সম্বন্ধে নানা সমস্যা মেটানোর উপদেশ দিলেন।
যা বলছি, আমরা ডিনার পার্টিতে ছিলাম। সেখানে আরও বহু নিমন্ত্রিত নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু আমি চিরাচরিত ভদ্রতা ত্যাগ করে ওই উদ্ভিদতত্ববিদের সঙ্গে কথা বলে কাটাই।
মাঝরাত এসে গেল। সকলের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। উদ্ভিদতত্ত্ববিদ এবার আমার নিমন্ত্রণকারীকে আমার সম্পর্কে প্রশংসাচ্ছলে অনেক কথা বললেন। আমি নাকি দারুণ উদ্দীপনায় ‘ভরপুর’, আমি ‘এই’, ‘তাই’ ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন কথাবার্তায় আমি চমৎকার।
আমি কথাবার্তায় চমৎকার? আমি? সে কি। ভদ্রলোকের সঙ্গে বোধ হয় দুএকটার বেশি কথাই বলিনি-বলার কিছু বোধ হয় ছিলও না কারণ উদ্ভিদতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কোনই জ্ঞান নেই। তবে আমি একটা কাজই করেছি–তাহলো গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছি। তার কারণ আমার আগ্রহ বাঁধ মানে নি। তিনি তা অনুভব করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি তাতে খুশি হন। এ ধরনের শোনার ব্যাপারই হলো সম্মান জানাবার সেরা পথ! জ্যাক উডফোর্ড তার ‘স্ট্রেঞ্জার্স ইন লাভ’ বইতে লিখেছেন খুব কম লোকই গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমি আরও কিছুটা বেশিই করি–আমি কথার মাঝখানে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলাম।
আমি তাঁকে বলেছিলাম তার কথায় আমার দারুণ উপকার হলো–আর সত্যিই তাই। আমি এও তাকে বলি, তাঁর মতো জ্ঞান থাকলে ভালো হতো। এ কথাও বলেছিলাম তার সঙ্গে মাঠে মাঠে ঘুরতে পারলে মজা হতো। তার সঙ্গে আবার দেখা করতেও চেয়েছিলাম।
এই কারণেই তিনি আমার কথাবার্তায় দক্ষ বলেন–আসলে আমি একজন ভালো শ্রোতা, আর তাকে কথা বলায় উৎসাহিত করেছি মাত্র।
ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফল সাক্ষাতের কাজের রহস্যটা কি? এ বিষয়ে চার্লস্ এলিয়ট বলেছেন, ‘সকল ব্যবসায়িক সাক্ষাতের ব্যাপারে কোন রহস্য নেই …. যিনি কথা বলছেন তার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনাই গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে স্তাবকতা আর হয় না।’
.
এ তো জানা কথা, তাই না? হার্ভার্ডে চার বছর পড়ে সেটা জানতে হয় না। অথচ আমরা জানি যে আপনারা জানেন ব্যবসায়ীরা প্রচুর খরচ করে বড় জায়গা নেন, পয়সা খরচ করে তাদের দোকান সাজানোর ব্যবস্থা করেন। তারপর যে সব কেরাণী নিয়োগ করেন তারা কিন্তু ভালো শ্রোতা না হওয়ায় ক্রেতাদের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয়। তারা ক্রেতাদের বিরক্তি উৎপাদন করার ফলে দোকান থেকে তাদের প্রায় পালাতে হয়।
জে. সি. উটনের কথাটাই ধরুন। তিনি আমার ক্লাসে এটা বলেন। একবার কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে তিনি একটা সুট কেনেন। সেটা খারাপ হয়ে যায়-রঙ উঠে গিয়ে সেটা কালারটাকে নষ্ট করে দেয়।
সুটটা নিয়ে গিয়ে তিনি বিক্রেতা লোকটিকে দেখান। লোকটি কোন কথাই শোনে না বরং নিজের কথাই বলতে চায়। তিনি অভিযোগ জানাবার আগেই সে বলতে থাকে, আমরা এরকম সুট হাজার হাজার বিক্রি করেছি, আর এরকম অভিযোগ এই প্রথম পেলাম।
লোকটার ব্যবহার জঘন্য হয়ে উঠলো। অপমানজনক ভঙ্গিতে সে বলল, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। আমাদের উপর জোর করে এসব চাপাবার চেষ্টা করছেন। আমাদের ঠকাতে চান আপনি।