.
একথা মনে রাখলে ভাল করবেন, প্রত্যেক বিতর্কিত বিষয়ে, তা সে যতই বিরাট আর তিক্ত মনে হোক, বক্তার সঙ্গে শ্রোতাদের কোথাও খানিকটা মিল থাকবেই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি : ১৯৬০ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারী গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের সংসদের উভয় সভায় কিছু বক্তৃতা দেন। তিনি সে সময় গ্রেট ব্রিটেনের বর্ণ বৈষম্য সংক্রান্ত নীতি ব্যাখ্য করেন। ওই সময় আবার দক্ষিণ-আফ্রিকায় ওই বর্ণ বৈষম্য নীতি পুরোপুরি বজায় ছিল। তিনি কি গোড়াতেই তার বিপরীত মত দিয়ে বক্তব্য আরম্ভ করেছিলেন? না। তিনি আরম্ভ করেন দক্ষিণ-আফ্রিকার চমৎকার অর্থনেতিক উন্নতি আর দুনিয়ার প্রতি সে দেশের দান সম্বন্ধে আলোচনা করে। তারপর বেশ কৌশল আর দক্ষতায় তিনি মত পার্থক্যের বিষয়ে অবতারণা করেন। এক্ষেত্রেও তিনি জানান তিনি জানেন এই মত পার্থক্যের যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ আছে। তাঁর সমস্ত বক্তৃতাই বেশ বিদগ্ধ অথচ দৃঢ়তাব্যঞ্জক ছিল। এতে মিশে ছিল লিঙ্কনের মতই দৃঢ়তাময় বক্তব্য। কমনওয়েলথের সদস্য এক রাষ্ট্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটাই আমাদের ইচ্ছা ও আগ্রহ যে তাদের সবরকম সহায়তা দান করা হোক, কিন্তু আমার আশা আমার এ কথায় আপনারা ত্রুটি ধরবেন না যে আপনাদের নীতির সঙ্গে, যে নীতি আমরা অনুসরণ করে চলেছি তার একটি মূলগত প্রভেদ গড়ে উঠেছে। আমার মনে হয় বন্ধুর মতই আমরা খোলাখুলি আলোচনা করতে পারব যে আজ আমাদের মাঝখানে এমন নীতি পড়ে রয়েছে যা সারা বিশ্ব মেনে নিতে অনিচ্ছুক।
এতেই বোঝা যাচ্ছে শ্রোতারা গ্রহণ করতে যতই অনিচ্ছুক থাকুক এমন বক্তব্য রাখলে তাদের তা না মেনে গত্যন্তর থাকে না। একবার ভাবুন, হ্যারল্ড ম্যাকমিলান গোড়াতেই মত পার্থক্য নিয়ে বলতে শুরু করলে তার পরিণতি কি হতে পারত?
প্রফেসার জেমস্ হার্ভে রবিনসন তার মাইও ইন দি মেকিং’ গ্রন্থে বলেছেন, মাঝে মাঝে কোন বাধা ছাড়াই আমাদের মন পরিবর্তন করি বা আবেগ বদলাই। কিন্তু কেউ যদি জানায় কোথাও আমরা ভুল করেছি আমরা সঙ্গে সঙ্গেই তা অগ্রাহ্য করতে তৈরি হই আর আমাদের মন কঠিন হয়ে ওঠে। আমাদের মনে কোন বিশ্বাস গড়ে ওঠার ব্যাপারে আমরা অবিশ্বাস্য রকম খেয়ালশূন্য, অথচ মনে গড়ে ওঠা কোন বিশ্বাসের কেউ সমালোচনা করলে আমাদের তা আঁকড়ে থাকার অদ্ভুত রকম বাসনা জেগে ওঠে। আমাদের বিশ্বাস আমাদের প্রিয়ময় আদৌ যা প্রিয় তা হল আত্মগর্ব …। আমরা যা বিশ্বাস করে আসি তাই মেনে চলতে চাই। এর ফল হল আমাদের যুক্তি কেবল সেটাই আঁকড়ে থাকতে প্রেরণা যোগায়।
৩. শ্রোতাদের উৎসাহিত করুন
কোন বক্তা যখন আবেগ আর উৎসাহ নিয়ে কোন বক্তব্য রাখার ভাবটি প্রকাশ করেন তখন মতপার্থক্য থাকলেও শ্রোতাদের মধ্যে প্রতিরোধ করার আকাঙ্ক্ষা জাগে না। এক্ষেত্রে ‘ছোঁয়াচে’ কথাটা ব্যবহার করছি–তার মানে হল এমনভাবে বক্তব্য রাখতে হবে যাতে শ্রোতারা তাৎক্ষণিক ভাবেই উৎসাহিত হতে পারে। আর এই উৎসাহ সৃষ্টি করতে হলে চাই সত্যিকার আন্তরিকতা। এক্ষেত্রে বক্তা যেভাবেই শুরু করুন না কেন। তার বাগবিন্যাস যেমনই হোক, তাতে অলঙ্কার বা অনুপ্রাস থাকুক চাই না থাকুক–প্রথম যা থাকা দরকার তা হল আবেগ আর বিশ্বাস। আপনার দৃষ্টি, অঙ্গ-ভঙ্গী, কণ্ঠস্বর সবকিছুর মধ্যেই প্রকাশ পাবে ওই আন্তরিকতা আর উৎসাহের আবেগ। শ্রোতারা এতে মুগ্ধ হবেই।
আপনি যখনই কোন জনসংযোগের কাজে নামবেন, বিশেষ করে শ্রোতাদের বিশ্বাস জন্মানোই যখন আপনার কাজ; তখন শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য রাখতেই হবে। আপনি যদি সাধারণ হন, শ্রোতারাও তাই হবে।
আমাকে একবার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদক বিতরণ উৎসবে তিনজনের বিচারক মণ্ডলীর একজন হিসেবে ডাকা হয়। গ্রহীতাদের মধ্যে ছিল প্রায় আধ ডজন আণ্ডার গ্র্যাজুয়েট। সকলেই শিক্ষিত আর পদকটি পাওয়ার জন্য আগ্রহী। কিন্তু তবু তাদের মধ্যে একটা জিনিসের অভাব ছিল–তারা বিশ্বাস জন্মানোর জন্য আগ্রহী ছিল না, তাদের একটাই আগ্রহ–যে কোন ভাবে পদকটি লাভ করা।
ছাত্ররা বক্তৃতার বিষয় ঠিক করেও রেখেছিল। অথচ বিষয় সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস জন্মানো নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। নিজেদের যুক্তিকে দৃঢ় করতে তাদের আকাঙক্ষারও অভাব ছিল। তাদের বক্তৃতাটা নিছক বক্তৃতাই হয়ে উঠেছিল।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল একজন জুলু রাজপুত্র। সে তার বক্তব্যের বিষয় ঠিক করে আধুনিক সভ্যতায় আফ্রিকার দান’। কথা বলার সময় আন্তরিকতার সঙ্গেই সে বক্তব্য রাখতে থাকে। তার প্রতিটি কথার পিছনে ছিল জ্বালাময়ী আবেগের স্পর্শ। শুধু শেখা কোন বক্তৃতা নয়-তার কথাগুলো হয়ে ওঠে সজীবতায় ভরা, আবেগ আর আন্তরিকা নিজের দৃঢ় বিশ্বাস মতই সে শ্রোতাদের নিজের কথা শোনাতে চায়–তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে চায়।
আমরা তাকেই পদকটি দিই, যদিও বক্তা হিসেবে সে হয়তো অন্যদের সমকক্ষ ছিল না। আমরা বিচারকরা তবুও তাকে পদকটি দিলাম এই কারণেই যে তার মধ্যে ছিল সত্যিকার আন্তরিকতা, সদিচ্ছা–তার প্রতিটি কথাই ছিল সত্যদর্শী। সেখানে বাকিদের বক্তব্য ছিল সাদামাটা।
রাজপুত্রটি অনেক দূরের এক দেশে শিখেছে যে একমাত্র ব্যক্তিত্বের জোরে কোন বক্তব্য গ্রহণীয় হয়, হয় না যুক্তি দিয়েও। আপনাকে বোঝাতে হবে নিজের বক্তব্যকে কতখানি বিশ্বাস করেন।