স্কিরোজ টেবিলের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–যদি আমি আর তুমি পরস্পরের বন্ধু হতাম।’
কেইন বলল, তার কোন আশা নেই। তুমি শেষ হয়ে গেছ। কোন ব্যু হলো না, সুয়েজ খাল এখনো খোলা। এখন তোমার ফুয়েরার কী বলবে?
তার মনে এখন অন্য চিন্তা চলছে। প্যানজার ডিভিশন গতকালই এগিয়েছে, বন্ধু। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে পোলান্ড শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।’
কেইন বলল, “আমি জানতাম সেই যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় হয়েছিল।
স্কিরোজ রুষ্ট চেহারা নিয়ে বলল, “তবে এবার নয়।’
‘আমি জানি, এরপর সারা পৃথিবী জানবে। মেরিকে কী করেছ?
স্কিরোজ তার সেই তেলতেলে কালো রঙের একটা চুরুট বের করে বেশ কসরত করে এক হাতে ধরাল। চুরুটের ধোয়া গলার ভেতরে ঢুকতেই খুক খুক করে কেশে উঠল। সত্যি এ ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ মজার মনে হচ্ছে। আমি কখনো ভাবিনি যে তুমি ভালোবাসা, রোমান্স এ ধরনের ব্যাপারে বিশ্বাস কর।
সে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে সামনে একটা ছোট দরজার দিকে এগোলো। তারপর দরজার তালা খুলে এক পাশে দাঁড়াল। মেরি বের হয়ে কামরায় ঢুকল।
এক মুহূর্ত সে সেখানে হতবুদ্ধি আর বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কেইনকে দেখেই সোজা তার দিকে ছুটে গেল।
“সে তোমার কোন ক্ষতি করেছে? কেইন বলল।
সে দুদিকে মাথা নাড়ল–না, কিন্তু তার কথাবার্তা তার মতোই জঘন্য।’
স্কিরোজ হাসতে লাগল, তার বিশাল শরীরের সমস্ত মাংশপেশি নাচতে শুরু করল। আমি ভাবছি যখন তোমার এই বন্ধু উপসাগরের শার্কের খাবার হবে তখন তুমি কীভাবে কথা বলবে।’ সে রিভলবারের ঘোড়া বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছনে টেনে কেইনের পেটের মাঝ বরাবর তাক করল।
কেইন স্কিরোজের পেছনে তাকাল। খোলা জানালা দিয়ে নোঙরের মোটা দড়ির গোছাটার দিকে তার দৃষ্টি পড়ল। হঠাৎ সে লক্ষ করল কিছু একটা সেখানে নড়ছে, তারপর দুটো হাত জানালার দু’পাশে উদয় হলো। এক মুহূর্ত পর জামাল সাবধানে মাথা উঁচু করে কেবিনের ভেতরে উঁকি দিল।
কেইন সর্বপ্রকারে চেষ্টা করল যাতে স্কিরোজ কথা চালিয়ে যায়। সে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে গিট দেওয়া রুমালটা বের করল যার মধ্যে ছিল সেই নেকলেসটা, যেটা সে শেবার সমাধির পথে পেয়েছিল।
রুমালের পুটুলিটা সে পিতলের কফি-টেবিলের উপর ছুঁড়ে ফেলল। তারপর শান্তস্বরে বলল, আমাকে মেরে ফেললে, তুমি জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করবে।’
জার্মান স্কিরোজ ককভাবে হেসে উঠল–”ওসব চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। এসব বলে তুমি নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।
কেইন রুমালটা তুলে গিটগুলো খুলতে শুরু করল। নিজ চোখে দ্যাখো। এটা শুধু একটা নমুনা। শেবার নেকলেস। আমরা এটা ঐ মন্দিরে পেয়েছি।’
সে নেকলেসটা আলোয় মেলে ধরল। পান্নার দূতি সবুজ আগুনের মতো ফুটে উঠল।
স্কিরোজের চোয়াল ঝুলে গেল আর তার চেহারায় বিস্ময় ফুটে উঠল-হলি মাদার অফ গড, এরকম রত্ন আমি জীবনে কখনো দেখিনি।’
সে কেইনের হাত থেকে নেকলেসটা কেড়ে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। এক মুহূর্ত পর মুখ তুলে তাকাল। তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠল। ঠিক জায়গামতো এর আকাশচুম্বি দাম পাওয়া যাবে। তোমাকে ধন্যবাদ।
এই পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল তার শেষ কথা। সে হাসতে শুরু করল, তার আঙুল রিভলবারের ট্রিগারে চেপে বসতে শুরু করেছে। আর তখনই জামাল দুহাত বাড়িয়ে শোয়ার কৌচটা পার হয়ে এল।
এক হাতে সে জার্মান লোকটার মুখ চেপে ধরল আর অন্য হাতে রিভলবারটা তার মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিল। স্কিরোজ ছাড়া পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জামাল এক হাতে তার গলা পেঁচিয়ে ধরল। তারপর তার এক হাঁটুর উপর স্কিরোজকে পেছন দিকে বাঁকা করে চেপে ধরল।
স্কিরোজের চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠল, সে পাগলের মতো দুই পা ছুঁড়তে শুরু করল। শুকনো গাছের ডাল ভাঙ্গার মতো মট করে একটা শব্দ হলো, তারপর তার দেহ স্থির হয়ে গেল।
আতঙ্কে মেরির দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হলো যখন জামাল তাকে মাটিতে শুইয়ে রাখল। কেইন মাটি থেকে নেকলেসটা তুলে নিল। এমন সময় জাহাজের পেছনের নোঙরটা জানালা অতিক্রম করে উপরের দিকে উঠে গেল আর বিশাল পালে বাতাস লাগতেই ধাউটা সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
কেইন জানালার দিকে ইঙ্গিত করে জামালকে সামনে ঠেলা দিল–’জলদি কর, আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
জামাল প্রথমে তার পা বের করে জানালা গলে অদৃশ্য হলো। ধাউয়ের গতি ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে আর এটা বন্দরের প্রবেশ মুখের দিকে চলতে শুরু করেছে। কেইন মেরিকে জানালা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিল।
তারপর সে পেছনে একবার জার্মান লোকটার পড়ে থাকা দেহের দিকে তাকাল। মুখ এদিকে ফেরানো আর চোখ খোলা। তারপর কেইন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিল।
পানি থেকে ভেসে উঠে সে দেখল ধাউটা দূরে চলে গেছে। সে মেরির দিকে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলল। চাঁদের আলোয় তাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
মেরি পানিতে পা চালিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কাছে আসতেই সে কেইনের হাত ধরল, তারপর তারা কিছুক্ষণ সেভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল।
ধাউটা তখন খোলা সাগরে অনেক দূরে ভেসে গেছে। সাগরের বাতাস পেয়ে পালটা ফুলে উঠেছে। আর কেইন মেরির দিকে তাকাল, তারপর কোন কারণ ছাড়াই ওরা হাসতে শুরু করল।