প্রায় ঘণ্টাখানেক পর, যখন ক্যানারিস তার ডেস্কে একগাদা ফাইলপত্র নিয়ে কাজ করছিলেন আর তার প্রিয় ডাকসান্ড কুকুরদুটো কামরার এককোণে একটা বাক্সে ঘুমিয়ে ছিল, তখন দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো। আর সাথে সাথে রিটার এক হাতে একটা ফাইল, বগলে রোল করা একটা ম্যাপ নিয়ে ঢুকল। সে তার লাঠিতে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনে এগুলো।
‘এই সুয়েজ খাল প্রকল্প নিয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে, হের এডমিরাল?
ক্যানারিস চেয়ারে পিঠ দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, ‘এত শীঘ্রই হান্স?’
‘আমিতো আগেই আপনাকে বলেছি, আমার মনে একটা বিষয় খচ খচ করছিল, অফিসে ফেরার পরই বিষয়টি মনে পড়ল। গত মাসেই আমি এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের একজন অধ্যাপক অটো মুলারের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পাই। কিছুদিন আগে তিনি দক্ষিণ আরব থেকে ফিরে এসেছেন। শীঘ্রই আবার সেখানে যেতে চাচ্ছেন। তবে তার আরো কিছু তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজন পড়েছে।
ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন, এর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?
আপনিতো জানেন হের এডমিরাল, যেসব জার্মান নাগরিক বিদেশে কাজ করেন, তারা কোন ধরনের অস্বাভাবিক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে এখানে এবহোয়ের সদর দপ্তরে রিপোর্ট করতে বাধ্য।
‘তো?”
‘আমাকে বলতে দিন, হের এডমিরাল, রিটার অন্যপাশের দেয়ালে টাঙানো ম্যাপ-বোর্ডের পাশে গিয়ে তার বগলের নিচ থেকে ম্যাপটা নিয়ে ঐ বোর্ডে পিন দিয়ে জায়গামতো টাঙালো। ম্যাপটিতে মিশর ও সুয়েজ খাল, পুরো দক্ষিণ আরব, লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগর দেখা যাচ্ছে।
‘আপনি এখানে দেখতে পাচ্ছেন হের এডমিরাল, ব্রিটিশ উপস্থিতি–ইয়েমন, এডেন উপসাগর জুড়ে বিভিন্ন আরব রাজ্য, ভারত মহাসাগর, দোফার এবং ওমান।
‘তারপর?’ ম্যাপটি নিরীক্ষণ করতে করতে ক্যানারিস জিজ্ঞেস করলেন।
‘আপনি নিশ্চয়ই উপসাগরের উপকূলে দাহরান বন্দরটি লক্ষ্য করেছেন। এখান থেকেই মুলার তার কাজ পরিচালনা করেন। এ জায়গাটি স্পেনের অধীনে। অনেকটা ভারতীয় উপকুল বন্দর গোয়র মতো। সেখানে স্পেনিয়রা কয়েকশো বছর ধরে রয়েছে।
‘আমি বুঝতে পারছি এ জায়গাটা অনেকটা সেরকম, ক্যানারিস বললেন।
উত্তরে সউদী আরবের সীমানা জুড়ে রয়েছে রাব আল খালি, শূন্য এলাকা, পৃথিবীর বুকে ভয়ংকর মরুভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম।
আর এখানেই মুলার কাজ করেন?
‘হ্যাঁ, হের এডমিরাল।
‘কিন্তু সেখানে তিনি কী কাজ করেন?
‘এ জায়গায় প্রাচীন সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। মুলার একজন ভাষাবিদ, বিশেষত প্রাচীন ভাষায়। তিনি ল্যাটেক্স দ্রবণ ব্যবহার করে শিলালিপির ছাপ তুলে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসেন।
‘এর সাথে সুয়েজ খালের কি সম্পর্ক, হান্স?
‘একটু ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনুন, হের এডমিরাল। সাবাহ্ নামে সেই এলাকাটির নাম বহুদিন ধরে শেবার রানির সাথে সম্পর্কিত হয়ে রয়েছে।
‘হায় ঈশ্বর!’ বলে কানারিস তার ডেস্কে গিয়ে বসলেন।
‘এতো দেখছি বাইবেল। তিনি একটা রুপার সিগারেট বাক্স থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। আমি তো সবসময় জেনে এসেছি বাইবেলে উল্লেখ ছাড়া আর কোন প্রমাণ নেই যে এর অস্তিত্ব আছে।’
‘হ্যাঁ, তিনি অবশ্যই ছিলেন। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি।’ রিটার বলল। ভেনাসের সমার্থক অ্যাসথার নামে এক আরব দেবীর উপাসক। সম্প্রদায় ছিল। শেবার রানি ছিলেন সেই সম্প্রদায়ের সব্বোর্চ পুরোহিত। আর তিনি সেই রাব আল-খালি এলাকায় একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
‘সেতো কাহিনীতে, ক্যানারিস বললেন।
‘হের এডমিরাল, মুলার এমন কিছু একটা আবিষ্কার করেছেন, যা সম্ভবত এর ধ্বংসাবশেষ। স্বভাবতই তিনি তার এই আবিষ্কার গোপন রেখেছেন। এ ধরনের একটি ঘটনা ভ্যালি অফ দি কিংস-এ তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। সারা দুনিয়া থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ছুটে আসবে সেখানে। আমি আপনাকে বলেছি, তিনি তহবিল সংগ্রহের জন্য বার্লিন ফিরে এসেছেন, তবে তিনি কী জিনিস আবিষ্কার করেছেন তার পূর্ণ বিবরণ এবহোয়েরের কাছে জমা দিয়েছেন।
ক্যানারিস ভ্রু কুঁচকে বললেন, তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে?
‘এ জায়গাটা অচেনা, হের এডমিরাল, মরুভূমির মাঝে লুকোনো রয়েছে। রসদ সরবরাহের জন্য একটা এরোপ্লেন ব্যবহার করে এই জায়গাটিকে সুয়েজ খাল আক্রমণের একটা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ক্যানারিস উঠে ম্যাপটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি সেটা পরীক্ষা করে ঘুরে বললেন, ‘ঐ জায়গা থেকে সুয়েজ খালের দূরত্ব কমপক্ষে এক হাজার মাইল হবে।’
‘খুব বেশি হলে বারোশো মাইল, হের এডমিরাল। কিন্তু আমি নিশ্চিত, উপায় একটা খুঁজে বের করা যাবে।’
ক্যানারিস মৃদু হাসলেন, তুমি সাধারণত তাই পারো, হান্স। ঠিক আছে মুলারকে নিয়ে এসে আমার সাথে দেখা করাও।
‘কখন, হের এডমিরাল?”
‘কেন, অবশ্যই আজ রাতে। আমি আজ রাতে অফিসেই ঘুমাবো।
তারপর তিনি তার টেবিলের দস্তাবেজের দিকে ফিরলেন। রিটার বের হয়ে গেল।
অধ্যাপক অটো মুলার একজন ছোটখাটো, টাক মাথার মানুষ। সারাক্ষণ রোদে থেকে থেকে তার মুখের চামড়া তামাটে হয়ে গেছে। যখন রিটার তাকে ক্যানারিসের সাথে সাক্ষাৎ করাবার জন্য কামরায় ঢুকালো, তখন নার্ভাস হয়ে সে মৃদু হাসতেই তার সোনা বাঁধানো দাঁত দেখা গেল।