পেছন থেকে একটা মৃদু কাশির শব্দ শোনা যেতেই কেইন না ঘুরে পেছনে এক হাত বাড়াল। পিরু তার হাতে বড় এক গ্লাস বরফ দেওয়া জিন-স্লিং দিল। সে শান্ত স্বরে বলল, সম্ভবত ক্যাপ্টেন গনজালেস বোটে তল্লাসি চালাবেন, সাহেব।
কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। সেজন্যই তাকে বেতন দেওয়া হয়।
সে আস্তে আস্তে গ্লাসের ড্রিংকস চুমুক দিয়ে শীতল আমেজটুকু উপভোগ করতে করতে তাকিয়ে দেখতে লাগল নৌকাটাকে এগিয়ে আসতে। নৌকা লঞ্চের গায়ে মৃদু ধাক্কা লাগতেই গনজালেস তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ঘামে তার সারা মুখ চক চক করছে। ডান হাতে একটা কাগজের জাপানি পাখা অনবরত নেড়ে মাছি তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
কেইন তার দিকে তাকিয়ে একটা সেঁতো হাসি দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে গরম তোমাকে পেয়ে বসেছে, জুয়ান।
গনজালেস কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে পরিষ্কার ইংরেজিতে উত্তর দিল, “শুধু মাত্র ডিউটি করার কারণেই একজন কর্তব্যরত অফিসার হিসেবে আমাকে বাধ্য হয়ে জেটিতে আসতে হয় যখন কোন মেইল বোট এডেন থেকে আসে। মাথা-ঢাকা কাপড়ের এক প্রান্ত দিয়ে সে মুখ মুছলো–”এবার কোত্থেকে এলে?
কেইন ড্রিংকসটা শেষ করে গ্লাসটা পিরুর হাতে দিল। সে তখনও ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বলল, “মুকাল্লা, মেরি পেরেটকে ডেলিভারী দেবার জন্য আমার কাছে কয়েকটা চিঠি রয়েছে।’
গনজালেস তার আঙ্গুলে চুমু খেয়ে বলল, “আহ, সেই আনন্দময়ী মাদমোয়াজেল পেরেট। আমরা হচ্ছি সুবিধাপ্রাপ্ত লোক। এইখানে এই পৃথিবীতে এক ঝলক স্বর্গ। তুমি কি কোন কার্গো এনেছো?
কেইন মাথা নেড়ে বলল, ‘ফেরার সময় আমরা একটা শার্ক আনতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বরশি শুদ্ধ অর্ধেকটা রশি সে নিয়ে গেছে।’
গনজালেস একটা হাত তুলে চোখ ঘুড়িয়ে বলল, ‘তোমরা, আমেরিকানরা এতে উৎসাহী—আর সেটা কিসের জন্য?
কেইন বলল, তুমি কি উপরে আসবে তল্লাশি চালাতে?’।
গনজালেস মাথা নেড়ে বলল, আমি কি একজন বন্ধুকে অপমান করব? সে হাতে ইশারা করে বৈঠাধরা লোকটাকে ফিরে যেতে বলল। আমি এখন বাসায় গিয়ে একটা লম্বা ড্রিংকস আর আমার স্ত্রীর শীতল হাতের পরশ নেবো।’
কেইন লক্ষ্য করল অনেকগুলো ধাওয়ের মাঝে নৌকাটা অদৃশ্য হয়ে। গেল। কিছুক্ষণ পর সিগারেটটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলে রেইল থেকে ঘুরে পেছন ফিরল। ভাবছি একটু সাঁতার কাটবো,’ সে বলল। ডেকটা মুছে ফেলে, পিরু। তারপর তুমি তীরে গিয়ে তোমার ভালোবাসার মেয়েটির সাথে দেখা করতে যেতে পারো।
সে নিচে কেবিনে গিয়ে দ্রুত পোশাক বদল করল। ডেকে যখন ফিরে এল, তখন তার পরনে একটা পুরনো খাকি শর্টস আর কোমরের বেল্ট থেকে ঝুলানো চামড়ার খাপে একটা কর্ক হ্যান্ডলওয়ালা ছুরি।
পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতে একটা রশি টানছে। কয়েকমুহূর্ত পর একটা বড় ক্যানভাসের বালতি উঠে এল। সে এর ভেতরের বস্তুগুলো ডেকে খালি করে বালতিটা আবার পানিতে ছুঁড়ে ফেলল।
কেইন ডাইভিং মাস্ক পরার প্রয়োজন বোধ করল না। সে দৌড়ে এসে পিরুকে পাশ কাটিয়ে রেইল টপকে সোজা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ জায়গায় বন্দরের গভীরতা প্রায় বিশ ফুট। সে পরিষ্কার সবুজ পানিতে সাঁতার কাটতে লাগল। কয়েকবার সাগরের তলদেশে গিয়ে সাদা বালুতে লাথি দিয়ে আবার উপরে উঠে এল।
প্রায় উপরে পৌঁছার পর দিক পরিবর্তন করে লঞ্চের নিচে পৌঁছাল। দুই গ্যালনের তেলের ক্যানটা তখনো একইভাবে আংটা থেকে ঝুলছে, যেভাবে সে রেখে গিয়েছিল।
দ্রুত সেটা পরীক্ষা করে উপরে ভেসে এল। পিরু রেইলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে হাতে ক্যানভাস বালতিটা নিয়ে। কেইন একবার মাথা নেড়ে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে আবার ডুব দিল।
তেলের ক্যানটার কাছে পৌঁছে ছুরিটা বের করে রশির বাধনটা কাটলো। একমুহূর্ত পরেই ক্যানভাসের বালতিটা তার পিঠে এসে ধাক্কা মারল। মুক্ত হাত দিয়ে সেটা টেনে নিয়ে এর ভেতরে তেলের ক্যানটা ঠেলে ভরলো। দুবার রশি ধরে টান দিতেই বালতিটা হালকাভাবে উপরের দিকে উঠে গেল।
কোন তাড়া নেই তার। সে আবার সাঁতার কেটে সাগরের তলদেশের সাদা বালুতে পৌঁছে অলসভাবে বুদবুদের ধারার মাঝে উপরে ভেসে উঠল। একটু পর ভেসে উঠে রেইল পেরিয়ে ডেকে উঠে দেখল কেউ নেই। শুধু একটা তোয়ালে পরিষ্কার ভাঁজ করে হ্যাঁচের উপরে রাখা রয়েছে। সে তাড়াতাড়ি গা মুছে নিচে গেল ভেজা চুল মুছতে মুছতে।
পিরু কেবিনের মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছে। দুই হাঁটুর মাঝে তেলের টিনটা ধরে বেশ নিপুণতার সাথে বাটালির চাপে ঢাকনিটা খুলে ফেলল। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা পেট মোটা পানি নিরোধক কাপড়ের পুটলি বের করল। মুখ তুলে বলল, আমি কি এটা খুলবো, সাহিব?’
কেইন মাথা নেড়ে বলল, “আমরা বরং স্কিরোজকে এই আনন্দটুকু উপভোগ করতে দেব। কারণ টাকা তো সেই দিচ্ছে। তুমি বরং তেলের টিনটা এখান থেকে সরিয়ে ফেল।
পিরু টিনটা নিয়ে উপরে ডেকে চলে গেল। কেইন কাপড়ের পুটলিটা হাতে নিয়ে এর ওজন আন্দাজ করল এক সেকেন্ড। তার ভ্রু কুঁচকে উঠল। তারপর সেটা টেবিলে রেখে বাংকে শুয়ে পড়ল।
ক্লান্তিতে তার সারা শরীর ভেঙে এল। হঠাৎ মনে পড়ল গত চব্বিশ ঘণ্টা সে ঘুমায়নি। চোখ বুজে সারা শরীর একটু শিথিল করল। এমন সময় লঞ্চের গায়ে একটা নৌকার ঘসা লেগে মৃদু শব্দ শোনা গেল আর পিরু হাজির হল দরজায়। সাহিব! সেলিম এসেছে।’