সে তাড়াতাড়ি মই বেয়ে নিচে নেমে আসতেই পিরু দড়ির বাঁধনটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে কানতারা সরে গেল। আর যখন সে উপরের দিকে তাকাল, ডেকের হলুদ আলোয় দেখা গেল মহিলাটি রেইলে হেলান দিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে। এক সময় রাতের অন্ধকারে ওরা মিলিয়ে গেল।
এই মুহূর্তের জন্য সে মন থেকে মহিলার কথা ঝেড়ে ফেলল। কেননা এখন অনেক জরুরি বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। দুই গ্যালনের তেলের টিনটা পিরু ডেকের যেখানে রেখেছিল সেখানেই আছে। কেইন সেটা দ্রুত একবার পরীক্ষা করে নিচে সেলুনে গেল।
পিরু এয়ার ট্যাংক রেডি করে রেখেছিল। কেইন সব পোশাক খুলে ফেলল, পরনে কেবল একটা শর্ট। পিরুর সাহায্য নিয়ে এয়ার ট্যাংকটা পিঠে বেঁধে নিল। পিরু হইল হাউস থেকে একটা শক্তিশালী স্পট ল্যাম্প নিয়ে এল। লম্বা একটা তার লাগানো আছে এর সাথে। পানির নিচে ব্যবহারের জন্য ল্যাম্পটা বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। তারের আরেক মাথার প্লাগ বোটের লাইটিং সিস্টেমের সাথে লাগানো আছে। তেলের টিনটার দুই মাথায় একটা আংটা ঝালাই করা আছে। পিরু একটা মোটা শনের দড়ি আংটার মধ্য দিয়ে ঢোকালো। কেইন ডাইভিং মাস্ক পরে শ্বাস নেবার নলের মাউথ পিসটা দাঁতের মাঝে শক্ত করে কামড়ে ধরল। তারপর এক হাতে ল্যাম্প নিয়ে লঞ্চের এক পাশ দিয়ে সাগরের পানিতে ঝাঁপ দিল।
এক মুহূর্ত অক্সিজেনের প্রবাহ ঠিক করার পর সাঁতার কেটে নিচে নেমে লঞ্চের তলায় গিয়ে পৌঁছাল।
নিস্তব্ধ এক জগতে একাকী ভেসে বেড়াবার অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করল। চারপাশে সাগরের পানি ফসফরাসের মতো জ্বলে উঠছে আর ল্যাম্পের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে আসা স্বচ্ছ মাছের দল উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
একটু পর তেলের টিনটা পানির মধ্য দিয়ে নিচে নেমে এল। কেইন এক হাতে রশিটা ধরে জাহাজের খোলের নিচে লাগানো দুটি আংটার মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দিল।
রশিটা আংটার মাঝে শক্ত করে বাঁধার সময় সে চারপাশের অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। সাগরের তলদেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে ভাস্বর মাছগুলোর কারণে, যেন অনেক মোমবাতি জ্বলছে। এক ঝাঁক ব্যারাকুড়া একটা রূপালি রেখার মতো বিদ্যুত গতিতে ছুটে গেল। তারপর আট ফুট দৈর্ঘ্যের একটা শার্ক ল্যাম্পের আলোর আভার মাঝে এসে থমকে দাঁড়িয়ে তাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
শাকটা সামনে এগোতেই সে মুখ থেকে শ্বাস নেবার নলটা খুলে ফেলল। সাথে সাথে রূপালি রঙের বুদবুদ মুখ থেকে বেরিয়ে এল। শাকটি তার লেজ দিয়ে পানিতে একটা ঝাপটা মেরে গতিপথ বদলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কেইন দ্রুত সাঁতার কেটে উপরে চলে এল, পিরু তাকে টেনে নিচু রেইলের উপর দিয়ে তুলল। সব ঠিক আছে তো সাহিব?’
কেইন মাথা নেড়ে ট্যাংকটার স্ট্র্যাপ খুলল। কোন সমস্যা নেই, শুধু একটা শার্ক ছাড়া। সে ব্যাটা একটু খেলা করতে চেয়েছিল।
পিরু অন্ধকারে সাদা দাঁতগুলো বের করে হেসে তার হাতে একটা তোয়ালে দিল। কেইন নিচে নেমে এল। পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা ছিল। সে গা রগড়ে মুছলো, তারপর পোশাক পরলো।
ডেকে বের হবার পর পিরু তাকে আরো এক মগ কফি দিল। কফি পান করতে করতে কেইন দূর দিগন্ত রেখায় কানতারার নেভিগেশন আলো দেখতে পেল। তখন আবার সেই মহিলার কথা মনে পড়ল।
দেখতে তিনি অবশ্যই সুন্দরী, কিন্তু কানতারার মতো একটা গামলায় কি করছিলেন! অবশ্য এর কোন সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মৃদু হেসে হুইলহাউসে ঢুকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে সে লঞ্চটা সামনের অন্ধকারে চালিয়ে নিয়ে চলল।
.
০৪.
পরদিন বিকালে তারা দাহরানে পৌঁছাল। লঞ্চটি বাঁকা শৈলান্তরীপ পার হতেই দুই মাস্তুলওয়ালা একটা ধাও–(আরবি স্টাইলের জাহাজ) বন্দর থেকে বের হয়ে এল। উপসাগরের বাতাসে এর পাল ফুলে উঠেছে। আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ধাওটি ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে।
কানতারা জেটিতে মাল নামাচ্ছিল। সমুদ্র সৈকতের বাঁকা অংশে জেলেরা ধৈর্য ধরে বসে তাদের জাল মেরামত করছে। আর নেংটা কয়েকটা শিশু অগভীর পানিতে খেলা করছে।
কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে পিরুকে ইশারা করল। সে লঞ্চের পেছনের ডেকে নোঙর নিয়ে তৈরি ছিল। নোঙরটা বন্দরের সবুজ পানিতে সশব্দে পড়ে নিচে অদৃশ্য হয়ে গেল। লঞ্চটা একটু সামনে এগিয়ে নোঙরের টানে পূব দিকের পাথুরে জেটির পঞ্চাশ কি ষাট গজ দূরে থেমে পড়ল।
পিরু কেবিনে অদৃশ্য হল। আর কেইন হুইলহাউস থেকে বের হয়ে এল। একটা সিগারেট ধরিয়ে লঞ্চের পেছন দিকে ধীরে ধীরে এগোল। সেখানে দাঁড়িয়ে এক পা পিতলের রেইলের সাথে ঠেকালো। রোদের প্রচণ্ড তেজ থেকে চোখ জোড়া বাঁচাতে তোবড়ানো নোনা দাগে ভরা পিক ক্যাপের সামনের অংশটা একটু বেশি নামিয়ে নিল।
বলিষ্ঠ গড়নের দীর্ঘদেহের অধিকারী একজন মানুষ, পরনে নিল ফেডেড ডেনিম আর সোয়েট শার্ট। বাদামি চুলগুলো রোদে ঝলসে প্রায় সাদা হয়ে গেছে। গালে তিন দিনের না কামানো দাড়ি। রোদে পোড়া মুখের চামড়া গালের হাড়ের উপর টান টান হয়ে আছে। গর্তে ঢোকা চোখ জোড়া শান্ত, ভাবলেশহীন। চোখের দৃষ্টি সবসময় দূরে তাকিয়ে রয়েছে, যেন কিছু একটা খুঁজছে।
বন্দরের দিকে তাকিয়ে সে দেখল নোঙর করা দুটো ধাওয়ের মাঝ খান দিয়ে একটা ছোট দাঁড়টানা নৌকা এগিয়ে আসছে। পেশিবহুল দেহের অধিকারী একজন আরব বৈঠা বাইছে। আর কুঁচকানো খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন দাড়িওয়ালা মোটা সোটা অফিসার তাকে দ্রুত যাওয়ার জন্য বলছে। অফিসারের মাথায় একটা সাদা। জড়ানো।