কেইন কান খাড়া করল। প্রথমে শুধু লঞ্চের গায়ে ঢেউ আছড়ে পড়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর বাতাসের শিস শোনা গেল। তারপর সে পানির উপর হালকা একটা কম্পন অনুভব করল। দূরে দেখা গেল সবুজ এক বিন্দু আলো-কানোরার স্টারবোর্ড নেভিগেশন বাতি।
“ঠিক সময়ের আগে নয়, সে মুদু স্বরে বলল।
কেইন হুইলহাউসে গিয়ে নেভিগেশন বাতি জ্বেলে স্টার্ট বোতাম টিপতেই ইঞ্জিন শব্দ করে চালু হলো। ধীরে থ্রটল খুলে অপেক্ষা করল যতক্ষণ না স্টিামারটা প্রায় তাদের উপরে এসে পড়ল, তারপর লঞ্চটা এগিয়ে নিয়ে দুটো জলযান সমান্তরাল করল।
পুরনো পণ্যবাহী জাহাজটা দুই কি তিন নট গতিতে চলছিল। কেইন লঞ্চটা কাছাকাছি আনতেই সংঘর্ষ এড়াতে পিরু দড়িদড়ার গুচ্ছটা বের করল। একজন লস্কর রেইলে হাজির হয়ে একটা দড়ির প্রান্ত ছুঁড়ে মারতেই পিরু সেটা ধরে বাধল। এক মুহূর্ত পর একটা দড়ির সিঁড়ি বের হতেই কেইন ইঞ্জিন বন্ধ করে ডেকে বের হয়ে এলো।
উঁচু মরচে ধরা কানতারার পেছনটা রাতের অন্ধকারে চোখে পড়ল। কালো লম্বা একটা ছায়ার মতো উপরে দেখা যাচ্ছে। দড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে কেইন আবার ভাবলো কি উপায়ে এই বাতিল লোহার টুকরাটা পানিতে ভাসছে।
সে রেইল আঁকড়ে ধরে টপকালো, তারপর হিন্দিতে বলল, ক্যাপ্টেন কিধার?’
লস্কর কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘কেবিনে।
সে দ্রুত কোম্পেনিয়ানওয়ে দিয়ে উপরের ডেকে পৌঁছে ক্যাপ্টেনের দরজায় টোকা দিল। কোন উত্তর নেই। এক মুহূর্ত পর সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। কেবিন অন্ধকার–তীব্র দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে আলোর সুইচটা অন করল।
ও’হারা বাংকে শুয়ে আছে।
পরনে হাতাকাটা গেঞ্জি আর প্যান্ট। হা করা মুখে হলুদ ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত দেখা যাচ্ছে। জাহাজের দুলুনির সাথে তাল মিলিয়ে একটা খালি হুইস্কির বোতল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কেইন ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বাইরে ডেকে চলে এল।
আরেকজন লস্কর তার জন্য অপেক্ষা করছিল। লোকটি বলল, “মেট বলেছে আপনাকে উপরে ব্রিজে যেতে।
কেইন দ্রুত ডেক পার হয়ে একটা লোহার সিঁড়ি বেয়ে ব্রিজে পৌঁছাল। পাগড়ি মাথায় মেট গুপ্ত হুইল ধরে আছে।
কেইন দরজায় ঠেস দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। কতক্ষণ হল সে এরকম আছে?’
গুপ্ত দাঁত বের করে হাসল। সেই যখন আমরা এডেন ছেড়েছি তখন থেকেই। অন্তত দুদিন ঘুমালে এই অবস্থা কাটবে।
‘জাহাজ চালাবার কি সুন্দর উপায়!’ কেইন বলল, “আচ্ছা এবার তোমাদের কি হয়েছে বলতো? নিয়মমাফিক বোম্বে থেকে আসার পর দাহরানে যোগাযোগ করনি কেন?
গুপ্ত জানাল, আমাদের কাছে মোম্বাসার কার্গো ছিল, তারপর এডেন।
কেইন বলল, ‘স্কিরোজ খুব একটা খুশি হবে না। মাল ঠিকঠাক আছে আশা করি।’
গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। ওরা এখনই মাল উপরে নিয়ে আসবে। ওহ! আরেকটা কথা এবারের ট্রিপে আমরা একজন যাত্রী নিয়ে এসেছি।’
‘যাত্রী?’ কেইন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল।এই গামলাতে?’
‘একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা। গুপ্ত বলল। তার খুব তাড়া ছিল এডেন ছেড়ে যাবার আর আমাদেরটাই ছিল একমাত্র জাহাজ। ক্যাটালিনাও এক সপ্তাহের আগে আসবে না।’
কেইন সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে বলল। তাহলে আমি আর এখানে বেশিক্ষণ থাকব না। ভদ্রমহিলাকে জাগাবার দরকার নেই। অহেতুক কৌতূহল সৃষ্টি করবে।
গুপ্ত মাথা নেড়ে সায় দিল। আমার মনে হয় সেটাই ভাল হবে। গতকাল ভোরের একটু আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে।
কী সেটা?
‘রোমেরোর ক্যাটালিনাটাকে দেখলাম প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে। একটা পর্তুগিজ পণ্যবাহি জাহাজের পাশে ল্যান্ড করল আর কিছু ক্রেট অফলোড় করল।’
‘সেটা আর আমরা এখানে যা করছি তার মাঝে কি পার্থক্য? তার মানে। রোমেরোও কিছু একটা স্মাগলিং করছে।’
কেইন কাঁধে একটা ঝাঁকি দিয়ে বলল। আমরা সবাই কিছু টা করছি। আচ্ছা আসি, আবার আগামী মাসে দেখা হবে।
তারপর সে লোহার সিঁড়ি বেয়ে নিচে ডেকে নেমে গেল। রেইলে ঝুঁকে দেখল দুজন লস্কর একটা তেলের ড্রাম লঞ্চের ডেকে পিরুর কাছে নামাচ্ছে। পেছন থেকে হঠাৎ একটা মৃদু নারী কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আপনার কাছে কি লাইটার আছে?
সে দ্রুত ঘুরল। গোলাকার নিটোল মুখের একজন দীর্ঘাঙ্গী। মাথায় একটা স্কার্ফ জড়ানো আর পরনে ডাস্টার কোট। কেইন লাইটার জ্বেলে দুহাত দিয়ে আড়াল করে ধরল। বেড়াবার জন্য সময়টা একটু বেশি রাত হয়ে গেল না?’
ভদ্রমহিলা এক মুখ ধোয়া ছেড়ে রেইলে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। আসলে আমি ঘুমাতে পারছিলাম না। এই জাহাজে যাত্রী সেবার ব্যবস্থা খুবই সীমিত।
‘সেটা আমি বিশ্বাস করি।’
‘আরেকজন আমেরিকানের সাথে দেখা হওয়ার আজব জায়গা এটা, তাই না?
কেইন দাঁত বের করে হাসল। আজকাল আমরা যেখানে সেখানে ভেসে উঠছি।
মহিলাটি রেইলের উপর ঝুঁকে তার লঞ্চের দিকে তাকিয়ে বলল। ওটা নিশ্চয়ই আপনার লঞ্চ?’
কেইন সায় দিয়ে বলল। আমি গভীর সমুদ্রের একজন মৎস্যশিকারী। দাহরান থেকে অপারেট করি। ঝড়ের কবলে পড়ে গিয়েছিলাম আর জ্বালানিও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস কানতারা এগিয়ে এল।
‘ও আচ্ছা।’ মহিলা বলল।
তার পারফিউমের সুগন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। আর কোন এক কারণে কেইন বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। এমন সময় লঞ্চ থেকে পিরুর হাঁক শোনা গেল। সে মৃদু হেসে বলল। এবার আমাকে যেতে হবে।’