সহকারী হাত বাড়িয়ে বলল, আপনাদের সাথে দেখা করার আগে তিনি এটা পড়তে চাচ্ছেন।
‘অবশ্যই।
ক্যানারিস তার হাতে ফাইলটা দিলেন; সেটা নিয়ে সে দরজা খুলে ভেতরে চলে গেল। ক্যানারিস বাকী দুজনের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে সবাইকে নিয়ে বসে পড়লেন।
মুলার একটু কাঁপছে দেখে ক্যানারিস বললেন, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?
‘হায় ঈশ্বর, আমি কীরকম বোধ করব বলে আপনি আশা করেন, হের এডমিরাল! এটাতো ফুয়েরার, আমাকে কি বলতে হবে?
যতো কম বলা যায় ততই মঙ্গল, ক্যানারিস তাকে বললেন। তারপর একটু শ্ৰেষমাখা কণ্ঠে বললেন, মনে রাখবেন, তিনি একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব, অতএব ঠিকমতো আচরণ করবেন।
দরজা খুলে গেল, সহকারী বলল, “ভদ্রমহোদয়গণ, ফুয়েরার এখন আপনাদের সাথে সাক্ষাত করবেন।
.
পুরো কামরাটি ছায়া ছায়া অন্ধকারে রয়েছে আর হিটলার একটা বিশাল ডেস্কে বসে রয়েছেন। একটি মাত্র পিতলের ল্যাম্প আলো দিচ্ছে। তিনি ফাইলটি পড়ছিলেন, এবার সেটা বন্ধ করে মুখ তুলে তাকালেন।
‘অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, হের এডমিরাল! একটি প্রথম শ্রেণীর কাজ।’
‘এর সমস্ত কৃতিত্ব ক্যাপ্টেন রিটারের।
না হের এডমিরাল, আমার মনে হয় এসবের পর মেজর রিটার বললে আরো উপযুক্ত হবে। সত্যি বলতে কি, আমি আপনাকে আগাম সতর্ক করে দিচ্ছি তাকে আমি আপনার কাছ থেকে চুরি করে আমার নিজস্ব স্টাফ করতে পারি।
তিনি উঠে দাঁড়াতেই রিটার যা বলা স্বাভাবিক তাই বলল–আপনি আমাকে খুব বেশি সম্মান করেছেন, মাননীয় ফুয়েরার।
হিটলার ডেস্ক ঘুরে মুলারের কাছে এলেন। প্রফেসার মুলার, তাই না? একটি বিস্ময়কর আবিষ্কার আর আপনি এটি রাইখের জন্য উৎসর্গ করছেন।’
আর মুলার কাঁপতে কাঁপতে সঠিক কথাটিই বলল–’শুধু আপনার জন্য, মাননীয় ফুয়েরার, কেবল আপনার জন্যই।
হিটলার তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, একটি বড় দিন আসছে, জার্মানির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দিন।
তিনি ধীরে ধীরে হেঁটে গেলেন আর ডেস্ক ল্যাম্পটি তার দেহের ছায়া ফেলল বিশাল পৃথিবীর মানচিত্রটির গায়ে। সেখানে তিনি হাত বেঁধে দাঁড়ালেন। আপনারা এবার যেতে পারেন।’
ক্যানারিস বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে ইশারা করে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন।
.
মুলারকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেবার পর ক্যানারিস ড্রাইভারকে বললেন তাদেরকে টিরপিজ উফারে নিয়ে যেতে। পাশের রাস্তাটিতে ঢুকতেই এক কোনে একটা রেস্তোরাঁর সামনে এলেন। জানালায় আলো দেখা যাচ্ছে।
ক্যানারিস একটু ঝুঁকে বললেন, এখানেই থামো। তারপর রিটারের দিকে ফিরে বললেন, ‘একটু কফি আর শ্যাপস। আমরা তোমার পদোন্নতি উদযাপন করব মেজর।
‘আমি অবশ্যই আনন্দিত হের এডমিরাল।
ক্যাফেটা প্রায় খদ্দের শূন্য ছিল আর এর মালিক ওদের দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। সে তাদেরকে জানালার পাশে একটা বুথে নিয়ে বসিয়ে খুব দ্রুত অর্ডার নিল। ক্যানারিস তার সিগারেট কেস বের করে রিটারকে এগিয়ে দিলেন। রিটার একটা সিগারেট নিয়ে তার লাইটার দিয়ে জ্বেলে দিল।
এডমিরাল ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, তিনি খুব খুশি হয়েছেন। অবশ্য মুলার একদম তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। লোকটা মোটেও শক্ত নয়।’
‘আমি একমত,’ রিটার বলল। তাকে ঠিকমতো চালাবার জন্য আমাদের একজন পেশাদার লোক দরকার।
ক্যাফের মালিক তাদের জন্য একটা ট্রেতে করে কফি আর পানীয় নিয়ে এল। ক্যানারিস তাকে হাত নেড়ে বিদায় করে দিলেন। তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে সেরকম কাউকে, একজন পুরোনো এবহোয়ের কর্মী, যার উপর আস্থা রাখা যায়।
‘কোন সমস্যা নেই, হের এডমিরাল।
‘তুমি তো বুঝতেই পারছো এই বিষয়টি এতো সরল যে এটা অবশ্যই কার্যকর করা যাবে।’ কথাটি বলে ক্যানারিস বোতল থেকে শ্যানপস দুটো গ্লাসে ঢাললেন।
‘আমি একমত, রিটার বলল।
ক্যানারিস মাথা নাড়লেন, তবে একটি সমস্যা আছে।
‘সেটা কি, হের এডমিরাল?
‘এটি আমাদের যুদ্ধে জয় এনে দেবে না, বন্ধু। কোন কিছুই তা করবে না। তুমি দ্যাখো হান্স, আমরা সবাই নরকে যাবে। তবে যাই হোক এটা তোমার পদোন্নতির জন্য।’
তিনি গ্লাসটি তুলে এক ঢোকে পুরোটা শেষ করে ফেললেন।
.
দাহরান, আগস্ট ১৯৩৯
০৩.
আফ্রিকা থেকে উপসাগরের উপর দিয়ে বয়ে আসা বাতাস তখনো দিনের উষ্ণতা নিয়ে আসছে কেইনের দেহে। সে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু শুনছিল।
চাঁদ না থাকলেও কোটি কোটি তারার আলোয় ভাস্বর আকাশ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে সে তাজা বাতাসের আস্বাদন নিল। তার চোখ অনুসরণ করছে একঝাক উড়ঙ্কু মাছকে যেগুলো সাগর থেকে বাঁকা হয়ে মৃদু আলোকিত পানির ঝর্নাধারা ছড়িয়ে বের হয়ে আসছে।
একটা দরজা খুলতেই সেলুন থেকে এক মুহূর্তের জন্য একঝলক আলো ছড়িয়ে পড়ল। হিন্দু খালাসি পিরু ধূমায়িত এক মগ কফি নিয়ে কোম্পেনিয়ানওয়ের উপর দিয়ে এগিয়ে এল।
কেইন একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাহ্ চমৎকার!’
‘সাহিব, আজ রাতে কানতারা আসতে বেশ দেরি করছে, পিরু বলল।
কেইন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ঘড়ি দেখল। প্রায় দু’টা বেজেছে। আমি ভাবছি ঐ বুড়ো শয়তান ও’হারা আজ কী খেলা খেলছে।’
‘আমার মনে হয় আবার হুইস্কিতে ডুবেছে।’
কেইন হেসে বলল, “হতে পারে।
সে কফি শেষ করতেই পিরু তার বাহু ছুঁলো। আমার মনে হয়ে সে আসছে।’