দলের ভেতর থেকে একজন হাত তুলা। ‘আচ্ছা, এভারেস্ট ভিউ হোটেলে একটা চক্কর মেরে আসলে কেমন হয়? গত ছয় দিন ধরে আমরা এই ছাতামার্কা তাবুতে ক্যাম্প করে সময় কাটাচ্ছি। ওখানে গিয়ে একটু গরম পানিতে গোসল করতে পারলে কিন্তু মন্দ হয় না।’
প্রস্তাবের সপক্ষে গুঞ্জন শোনা গেল।
‘আমার মনে হয় না, কাজটা খুব একটা ভাল হবে,’ সাবধান করল জশ। ‘ওই হোটেলে যেতেই লাগবে এক দিন। হোটেলে রুমগুলোতে উচ্চতা জনিত সমস্যা মোকাবেলার জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু ওখানে থাকলে আপনাদের এই বর্তমান সহ্য শক্তি দুর্বল হয়ে যাবে। মোটের ওপর, আমাদের অভিযানের দেরি হয়ে যাবে।’
‘হ্যাঁ! আমরা তো খুব দ্রুত এগোচ্ছি! কোনও দেরি হচ্ছে না!’ ফোড়ন কাটল বোস্টন বব।
জশ ববকে পাত্তা দিল না। লিসা খুব ভাল করেই জানে, তাঁর ছোট ভাইকে বৈরি আবহাওয়ার ব্যাপারে কোনো বিষয়ে জোর করে লাভ হবে না। জশ অহেতুক কোনো ঝুঁকি নেবে না। যদিও এখন আকাশ একদম ঝকঝকে নীল দেখাচ্ছে। কিন্তু লিসা এ-ও জানে, আকাশের এই রূপ বদলাতে বড়জোর কয়েক মিনিট লাগে। ক্যাটালিনা কোস্টের সাগরের পাশে বড় হয়েছে ও আর জশ। ওরা দুজনই জানে ঝকঝকে মেঘমুক্ত আকাশ কী করে রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। আকাশের ভাব-গতি ওদের চেনা আছে। আবহাওয়ার নাড়ি-নক্ষত্র বোঝার জন্য শেরপা’র মতো অত দক্ষ চোখ হয়তো জশের নেই কিন্তু একজন শেরপার সিদ্ধান্তকে সে সম্মান দিতে জানে।
এভারেস্টের চূড়ায় ভাসমান তুষার পুচ্ছের দিকে তাকাল লিসা। তুষার পুচ্ছের ধারা শিখরের ওখান দিয়ে ঘন্টায় দুইশ’ মাইলেরও বেশি গতিতে ছুটছে। পুচ্ছটির লেজ বেশ দীর্ঘ। দেখে মনে হচ্ছে আট হাজার মিটার উপরের ওই জায়গায় তুষার ঝড় বেশ ভালই তাণ্ডব চালাচ্ছে। এই ঝড় যে-কোনো মুহূর্তে ওদের দিকে ধেয়ে আসতে পারে।
‘আচ্ছা, আমরা অন্তত ক্যাম্প ওয়ান পর্যন্ত তো যেতে পারি, নিজের মত দাঁড় করানোর চেষ্টা করল বোস্টন বব। ওখানে গিয়ে তারপর নাহয় আবহাওয়ার মতি-গতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে’।
আমতা আমতা করে যতটা সম্ভব সাবধানে নিজের অভিমত দিল স্পোর্টস স্টোরের ম্যানেজার। এখানে আরও সাত দিন বসে থাকতে হবে ভেবে হতাশায় তার চেহারা লাল হয়ে গেছে।
এই লোকটার প্রতি লিসা আগে অনেক আকর্ষণবোধ করতো।
ববের কথার জবাবে উঁচু গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল জশ। কিন্তু নতুন একটা আওয়াজ ওকে বাধা দিল। ড্রাম থেকে উৎপন্ন থাম্প-থাম্প ধরনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শব্দের উৎস, পুব দিকে চোখ ঘোরাল সবাই। উদীয়মান সূর্যকে পেছনে রেখে একটা কালো হেলিকপ্টার এগিয়ে আসছে। দেখতে অনেকটা ভীমরুলের মতো, বি-টু স্কুইরেল এ-স্টার ইকুইরেল। উদ্ধারকারী হেলিকপ্টার। এভারেস্টের মতো বিশালাকৃতির পাহাড়ের গায়ে নির্বিঘ্নে উদ্ধার অভিযান চালানোর জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয়েছে একে।
দলের মাঝে পিনপতন নীরবতা।
এক সপ্তাহ আগে, সর্বশেষ ঝড় শুরু হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে একটা দল নেপালের সাইড দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। রেডিও যোগাযোগের মাধ্যমে ওরা পৌঁছে গেছিল ক্যাম্প টু-তে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে একুশ হাজার ফিটের বেশি উচ্চতায়।
সূর্যের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করল লিসা। ওই দলের কোনো বিপদ হয়েছে নাকি?
ফিরিচের হিমালয় রেসকিউ অ্যাসোসিয়েশনের হেলথু ক্লিনিকে (এইচ.আর.এ) গিয়েছিল লিসা। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে বিভিন্ন রোগে ও অসুস্থতায় পড়ে পবর্তারোহীরা এখানে ভর্তি হয়। হাড় ভাঙ্গা, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত সমস্যা, মাংসে বরফের পচন ধরাসহ, হৃদরোগ, আমাশয়, তুষার অন্ধতা, বিভিন্ন রকমের জখম এবং এসটিডি নিয়ে এই ক্লিনিকের কাছে দারস্থ হয় পর্বতারোহীরা। এমনকী যৌনরোগ নিয়েও এখানে অনেকে ভর্তি হয়।
কিন্তু এখন কী হয়েছে? রেডিওর জরুরি ব্যান্ডে তো কোনো বিপদ সংকেত পাওয়া যায়নি। একটা হেলিকপ্টার বেজ ক্যাম্পের চেয়ে একটু উঁচু পর্যন্ত উড্ডয়ন করতে পারে। পাতলা বায়ুর কারণে তারপর আর এগোতে পারে না। যার মানে, হেলিকপ্টারটা নির্দিষ্ট উচ্চতা পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চালাতে সক্ষম। পঁচিশ হাজার ফিটের উপরে কোনো লাশ থাকলে সেটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এভারেস্টের বরফ শীতল কবরে সেই লাশের ঠাই হয়। পরিত্যক্ত গিয়ার, শূন্য অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাথে লাশের সলিল সমাধি ঘটে। বরফে শক্ত হয়ে মমির মতো রয়ে যায় এভারেস্টের গায়ে।
হেলিকপ্টারের আওয়াজে একটু পরিবর্তন এলো।
‘ওটা এই দিকে আসছে,’ বলল জশ। সবাইকে স্টর্ম তাবুর কাছে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিল। হেলিকপ্টারকে নামার জন্য সামনে থাকা সমতল কঁকা করল ও।
আকাশ থেকে অবতরণ করল কালো হেলিকপ্টার। রোটরের বাতাসে বরফের টুকরো এদিক-সেদিক ছিটকে গেল। কী যেন সঁই করে ছুটে গেল লিসার নাকের ঠিক নিচ দিয়ে। প্রেয়ার পতাকাগুলো বাতাসের ঝাপটায় উন্মাদের মতো নৃত্য শুরু করেছে। ইয়াকওলো চেঁচিয়ে উঠল। পাহাড়ের গায়ে অনেক দিনের জমে থাকা সুনসান নীরবতা আজ কেটে গেল।
কিডের ওপর ভর দিয়ে নামল হেলিকপ্টার। দরজা খুলে বেরিয়ে এল দু’জন। একজনের পরনে সবুজ ক্যামোফ্লেজ ইউনিফর্ম, কাঁধে অটোমেটিক ওয়েপন, রয়েল নেপালিজ আর্মির একজন সৈন্য সে। আরেকজন বেশ লম্বা, পরনে লাল রঙের গাউন কোমরের ওখানটায় শার্শির রশি বাঁধা, পুরো মাথা পরিষ্কার করে কামানো। বুদ্ধ সন্ন্যাসী।