আর এই গবেষণার কাজেই ডা. লিসা পৃথিবীর ছাদ অর্থাৎ এভারেস্টে এসেছে।
শেরপা তাসকি’র আরেকটা ছবি তোলার জন্য তৈরি হলো লিসা। অন্যান্য শেরপার মতো তাসকি তার দলকে নিজের নামের মতো আগলে রেখেছেন।
পতপত করে উড়তে থাকা প্রেয়ার পতাকাগুলোর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে দাঁড়ালেন তাসকি। ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। হাতের দুই আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট ধরে এভারেস্টের চূড়ার দিকে তাক করে আছেন। দিনটা ভাল না। এই বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে। একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। হাত নামিয়ে সরে গেলেন। নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন তাসকি।
যদিও দলে থাকা অন্যান্যের মতামত এখনো নেয়া হয়নি।
দলের সদস্যদের মাঝে আপত্তিসূচক গুঞ্জন শোনা গেল। মুখ তুলে মেঘবিহীন নীল আকাশ দেখল সবাই। দশ জনের এই দলটি বিগত নয় দিন যাবত অনুকূল আবহাওয়াপূর্ণ একটা ভাল দিনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর আগে, ঠিক গত সপ্তাহে যখন ঝড় হয়েছিল তখন পাহাড়ে না ওঠার ব্যাপারে অবশ্য কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের কারণে এখানকার পরিবেশ একদম খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একশ মাইলেরও বেশি বেগে আসা ঝড়ো হাওয়া নাজেহাল করেছিল ক্যাম্পকে। রান্নার জন্য খাটানো তাবু উড়ে গিয়েছিল, মানুষজনকে শুইয়ে ফেলেছিল উন্মত্ত হাওয়া। তার ওপর তুষার ঝরার ফলে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল। তুষার এসে যেন ত্বক ডলে দিচ্ছিল সিরিশ কাগজের মতো।
পরদিন ভোরটা হলো পর্বতারোহীদের আশার মতো উজ্জ্বল। সূর্যের আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল কুমু হিমবাহ আর বরফের দেয়াল থেকে। সবার মাথার উপরে তুষারাবৃত এভারেস্ট অবিচল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এভারেস্টের আশেপাশে রয়েছে আরও কয়েকটা পাহাড়ের চূড়া। দেখে মনে হচ্ছে, সাদা পোশাকে কোনো বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে।
একশ’র মতো ছবি তুলল লিসা। দিনের আলো পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশেরও যে সৌন্দর্যের পরিবর্তন ঘটে সেটা ধরা পড়ল ওর ক্যামেরায়। এভারেস্টের স্থানীয় নামের মর্ম বুঝল ও। চোমোলাংমা, চীনা ভাষা। অর্থ করলে দাঁড়ায়–পৃথিবীর স্বর্গীয় দেবী। নেপালিতে বলে সাগারমাতা। অর্থাৎ, আকাশের দেবী।
মেঘের মাঝে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা বরফ ও চুড়া সমৃদ্ধ এই পর্বত যেন সত্যিই এক দেবী। ওগুলো যেন এভারেস্টের পূজো করতে এসেছে, আকাশকে ছুঁয়ে চুমো খাওয়ার জন্য নিজেদেরকে প্রমাণ করছে ওরা। জনপ্রতি খরচা হয়েছে পয়ষট্টি হাজার ডলার। ক্যাম্পের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কুলি, শেরপা, ইয়াক (চমরি গাই); এসব কিছুর ব্যবস্থা হয়েছে ওই পয়ষট্টি হাজার টাকার মধ্যে। খাটো সাইজের একটা মাদি ইয়াক ডাক ছাড়ল, ওর ডাক প্রতিধ্বনি হলো উপত্যকার গায়ে। পর্বতারোহীদের কাজের জন্য দুই ডজন ইয়াক আছে এখানে। ওগুলোর লাল-হলুদ রঙ ক্যাম্পের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ঝড়ের দেবতা কবে এখান থেকে ফিরে যাবেন এই আশায় আরও পাঁচটা ক্যাম্প এই পাথুরে পাহাড়ি ঢলে অপেক্ষা করছে।
তবে ওদের প্রধান শেরপার ভাষ্য অনুযায়ী, ঝড়ের দেবতা আজ ফিরে যাচ্ছেন না।
‘একদম বিরক্ত হয়ে গেলাম,’ বোস্টন স্পোর্টিং কোম্পানির ম্যানেজার ঘোষণা করলেন। তার পরনে লেটেস্ট ডাউন-ডুভেট ওয়ান পিস। নিজের ভারি প্যাকের পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত আড়াআড়ি অবস্থায় রেখেছেন তিনি। বসে বসে দিন প্রতি ছয়শ ডলারেরও বেশি অপচয় করছি। ওরা আমাদেরকে ঠকাঁচ্ছে। আকাশে তো মেঘের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই!
বিরক্ত হলেও নিজের গলার স্বর যতদূর সম্ভব নিচু রেখেই কথাগুলো বললেন তিনি। অসন্তোষ প্রকাশ করে সবার সামনে খারাপ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।
লিসা এরকম স্বভাবের লোক আগেও দেখেছে। এই স্বভাবের লোকগুলো খচর টাইপের হয়। লোকটার সাথে এক বিছানায় রাত কাটানো ঠিক হয়নি, ভাবল লিসা। স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করল ও। স্টেটস্-এ একটা সাক্ষাতের কথা মনে পড়ল। সেটুল এর হ্যাঁয়াটে একটা প্রাতিষ্ঠানিক মিটিঙের পর বেশ খানিকটা হুইস্কি খেয়ে ওখানে গিয়েছিল লিসা। লিসা যদি একটা জাহাজ হয় তাহলে বোস্টন বব হলো এক বন্দরের নাম। এই অঞ্চলে বব ছাড়া হয়তো আরও বন্দর আছে। কিন্তু লিসা একটা ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে কখনো বোস্টন ববের বন্দরে নোঙ্গর করবে না ও।
ওর এরকম ভাবনার অন্যতম কারণ হলো এই লোকটার বিরক্তিকর স্বভাব। লোকটা সবসময় উল্টো কথা বলে। মেজাজটা এমন, যেন যুদ্ধ করবে।
অন্যদিকে মুখ ঘোরাল লিসা। রাগ করে শক্তি নষ্ট করার দরকার নেই। ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল ও। জশ; লিসার ছোট ভাই। বিগত দশ বছর ধরে পর্বতারোহণ করছে সে। অভিজ্ঞতা প্রচুর। বোনের টিমে সে একজন পথ প্রদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। বছরে কম করে হলেও দুবার এরকম পর্বত অভিযানে দায়িত্ব পালন করে জশ।
জশ কামিংস ওর এক হাত উঁচু করল। বোনের মতো সে-ও স্বর্ণকেশী, হালকা পাতলা। পরনে কালো জিন্স, ওর স্পোর্টস বুটের ভেতরে গরম পরিধেয় গুঁজে রাখা। গায়ে দিয়েছে ধূসর রঙের থার্মাল শার্ট। বিভিন্ন অভিযানের জন্য এই শার্টগুলো বিশেষভাবে তৈরি হয়ে থাকে।
গলা খাকারি দিল ও। ‘তাসকি বারো বার এভারেস্টে উঠেছেন। পাহাড়ের মতি গতি ভাল বোঝেন তিনি। যদি তিনি বলেন, সামনে এগোনোর জন্য আবহাওয়া সুবিধের নয় তাহলে আমরা এখানে আরও একটা দিন থাকব। আমাদের সময় পার করব দক্ষতার চর্চা করে। আর যদি কেউ অন্য কোথাও ঘুরে আসতে চায়, সেক্ষেত্রে আমি তাদেরকে দুটো গাইড দিয়ে দিতে পারি। একদিনের জন্য তাঁরা রডোডেনড্রন বনের কুমু উপত্যকা থেকে ঘুরে আসতে পারে।‘