মৃত।
আওয়াজটা আবার হলো। কান্নার আওয়াজ। নারী দেহের ওপাশ থেকে এসেছে।
নারীর নিচে বাচ্চাটির দেহ অর্ধেক চাপা পড়ে আছে। সারা গায়ে রক্ত।
বাচ্চাটি ভিজে ঠাণ্ডায় নীল হয়ে গেছে, বেঁচে আছে এখনো। নারী দেহের নিচ থেকে বাচ্চাটিকে উদ্ধার করলেন ফাদার। ভেজা বাচ্চাটিকে নিজের গায়ের কাপড় দিয়ে জড়িয়ে নিলেন তিনি।
ছেলে শিশু।
তিনি দ্রুত বাচ্চাটির পুরো শরীর পরীক্ষা করলেন। দেখলেন রক্ত বাচ্চার শরীর থেকে ঝরেনি। মায়ের শরীরের রক্ত বাচ্চাটির শরীরে মেখে গিয়েছিল।
দুঃখ মাখা দৃষ্টিতে বাচ্চার মায়ের দিকে তাকালেন তিনি। এত মানুষ মারা যাচ্ছে। নদীর ওপারে তাকালেন। পুড়ছে শহর, ধোঁয়া দলা পাকিয়ে উঠে আকাশে আশ্রয় নিচ্ছে। গুলিবর্ষণ চলছে এখনো। এই নারী কী বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য পুরো নদীপথ পাড়ি দিয়ে এসেছিল?
‘শান্তিতে থাকো, নারীকে উদ্দেশ্য করে বললেন ফাদার। শান্তিই তোমার প্রাপ্য, তুমি এটা অর্জন করে নিয়েছ।’
ফাদার ভেরিক প্যাসেজের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। রক্ত, পানি মুছে দিলেন বাচ্চার শরীর থেকে। বাচ্চার মাথার চুলগুলো তুষারের মতো সাদা; বেশ নরম, পাতলা। বয়সে এক মাসের বেশি হবে না।
ফাদারের পরিচর্যা পেয়ে বাচ্চার কান্না আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে খুব জোর দিয়ে কাঁদছে বাচ্চাটি, ওর ছোট্ট চেহারায় সেটার ছাপ ফুটে উঠল। যদিও এখনো ও দুর্বল, ঠাণ্ডায় কাতর।
‘বাবু, তুমি কাঁদছ।
ফাদারের কণ্ঠ শুনে বাচ্চাটি চোখ খুলল। কেঁদে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেলেছে। সুন্দর নীল চোখ মেলে তাকাল ফাদারের দিকে। নীল চোখ বুদ্ধিমত্তা ও সতোর পরিচয় বহন করে। যদিও এখানকার অধিকাংশ নবজাতক নীল চোখ নিয়েই জন্ম নেয়। তবুও, ফাদারের মনে হলো, এই চোখ জোড়া নীল চোখের সুনাম রাখবে।’
শরীরের উষ্ণতা দেয়ার জন্য বাচ্চাটিকে আরও কাছে নিলেন ফাদার। একটা রং তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আরে কী ওটা? বাচ্চাটির পা দেখলেন তিনি। গোড়ালির ওপর কে যেন একটা চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
না, আঁকেনি। ঘষে নিশ্চিত হয়ে নিলেন ফাদার।
গাঢ় লাল কালি দিয়ে ট্যাটু করা হয়েছে।
তিনি ট্যাটুটা ভাল করে দেখলেন। দেখতে একটা কাকের থাবার মতো লাগছে।
ফাদার ভেরিক তার তরুণ সময়ের একটা বড় অংশ ফিনল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন। সেই সূত্রে, এই চিহ্ন চিনতে পারলেন তিনি। নরওয়েজীয় প্রাচীন বর্ণমালার একটা হলো এই চিহ্ন। কিন্তু এই বর্ণ দিয়ে ঠিক কী বুঝানো হয়েছে তা সম্পর্কে ফাদারের কোনো ধারণা নেই।
মাথা নাড়লেন তিনি। এরকম বোকামি কে করল?
তিনি বাচ্চার মায়ের দিকে আবার তাকালেন।
পিতার পাপের বোঝা সন্তানকে বইতে হবে না।
বাচ্চার মাথায় লেগে থাকা রক্তের শেষ ফোঁটাটুকু মুছে দিলেন ফাদার। নিজের উষ্ণ গাউনের ভেতরে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে নিলেন।
‘ছোট বাচ্চা… পৃথিবীতে এসেই কী কঠিন পরিস্থিতির মুখেই না পড়েছে।‘
.
প্রথম খণ্ড
০১.
রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড
বর্তমান সময় ১৬ মে, সকাল ৬:৩৪ মিনিট।
হিমালয়
এভারেস্ট বেজ ক্যাম্প, ১৭ হাজার ৬০০ ফিট।
বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে।
প্রধান শেরপা তাসকি তার পেশাদারিত্বের গাম্ভীর্য বজায় রেখে ঘোষণা করলেন। এই ব্যক্তি বেশ খাটো। মাথায় থাকা কাউবয় হ্যাটসহ তার উচ্চতা টেনে-টুনে পাঁচ ফুট হতে পারে। কিন্তু যেভাবে পাহাড় বেয়ে তরতর করে উঠে এসেছেন তাতে মনে হয়, তিনিই বুঝি এখানকার সবার চেয়ে লম্বা ব্যক্তি। আড়চোখে প্রেয়ার পতাকাগুলোর দাপাদাপি দেখছেন তিনি।
ডা. লিসা কামিংস ওর নিকন ডি-১০০ ক্যামেরার ঠিক মাঝখানে আনল তাসকিকে। ছবি তুলল। তাসকি এই গ্রুপের গাইড হিসেবে কাজ করলেও লিসার কাছে তিনি একটা সাইকোমেট্রিক টেস্ট সাবজেক্ট। লিসা বর্তমানে যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছে সেটার জন্য একদম মোক্ষম ব্যক্তি এই তাসকি।
অক্সিজেনের কোনো বাড়তি সরবরাহ ছাড়া এভারেস্টে উঠতে গেলে মানব শরীরে কী কী প্রভাব পড়ে সেসব নিয়ে গবেষণা করার জন্য নেপালে এসেছে লিসা। ১৯৭৮ সালের আগে কেউ-ই বাড়তি অক্সিজেন সরবরাহ ছাড়া এভারেস্ট জয় করতে পারেনি। এখানকার বাতাস খুবই পাতলা। অবস্থা এতটাই নাজুক যে, প্রচুর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পর্বতারোহীরা বোতলজাত অক্সিজেনের সাহায্য নিয়েও বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। যেমন : দুর্বল হয়ে যাওয়া, বিভিন্ন অঙ্গের সমন্বয়তার অভাব, একজন মানুষকে দুজন দেখা, দৃষ্টিভ্রম ইত্যাদি। ধরে নেয়া হয়েছিল, এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়া অর্থাৎ আট হাজার মিটার উচ্চতায় বোতলজাত অক্সিজেনের সহায়তা ছাড়া পৌঁছুনো অসম্ভব।
তারপর ১৯৭৮ সালে দু’জন আনাড়ী পবর্তারোহী এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন। হাঁপাতে থাকা ফুসফুস নিয়ে তারা পৌঁছে গেলেন এভারেস্টের চূড়ায়। পরবর্তী কয়েক বছরে প্রায় ৬০জন নারী-পুরুষ সেই দু’জন পর্বতারোহীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এভারেস্ট জয় করে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
নিম্ন-চাপযুক্ত বায়ুমণ্ডলে মানব শরীর কেমন আচরণ করে সেটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এরচেয়ে আর ভাল পরিবেশ পাওয়া লিসার পক্ষে সম্ভব নয়।
এখানে আসার আগে উচ্চ-চাপে মানব শরীর কেমন আচরণ করে-এর ওপর পাঁচ বছর পড়াশোনা করেছে লিসা। পড়ার পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ডিপ ফ্যাদম নামের এক রিসার্চ শিপে চড়ে গভীর সমুদ্রে গিয়ে ডুবুরিদের পর্যবেক্ষণ করেছে। তারপর ওর ব্যক্তিগত ও পেশাগত দুটো জীবনেই পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ায় এনএসএফ-এর প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল ও। এবার ওর গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ উল্টো : নিম্নচাপযুক্ত বায়ুমণ্ডলে মানব শরীর কেমন আচরণ করে তা পর্যবেক্ষণ।