দুর্বল টোলাও।
টোলার গলার একপাশ ভেদ করে বুলেট বেরিয়ে গেছে। টকটকে লাল রক্ত নিঃশব্দে মিশে যাচ্ছে পানিতে। দৃষ্টিশক্তি কমে গেছে টোলার। পানির ওপরে বাচ্চাটিকে ধরে রাখার জন্য রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধ করছে।
কিছুক্ষণ আগে, বাচ্চাসহ ও যখন পানিতে লাফ দিয়েছিল তখন ইচ্ছে ছিল ওরা দু’জনই পানির নিচে মারা যাবে। সোজা কথায়, বাচ্চাটিকে নিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল টোলা। কিন্তু বরফ শীতল পানি আর গলায় বুলেটের আঘাত পাওয়ায় ওর পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসে। চার্চের চুড়ো এসে পড়া সূর্যের আলোর কথা মনে পড়ল ওর। না, ও ধর্মের কথা স্মরণ করেনি। আলোর কথা মনে পড়ায় ও উপলব্ধি করতে পেরেছিল “মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে।” পৃথিবীর অনেক জায়গা এরকম আছে যেখানে ভাই ভাইয়ের সাথে লড়াই করে না। মায়েরা তাদের বাচ্চাদেরকে খুন করে না।
পানির আরও গভীরে সঁতরে গিয়েছিল টোলা। স্রোত ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ব্রিজের দিকে, আপত্তি করেনি ও, স্রোতের মর্জিমতো ভেসে গিয়েছে। পানির নিচ দিয়ে ডুব-সাঁতার দেয়ার সময় নিজের ফুসফুসে থাকা বাতাস বাচ্চাকে দিয়ে বাঁচিয়েছিল টোলা। হাত দিয়ে বাচ্চাটির নাক চেপে মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস দিয়েছিল ও। যদিও ওর ইচ্ছে ছিল আত্মহত্যা করবে কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করার পর যখন বাঁচার জন্য সংগ্রাম শুরু করল তখন টোলা হয়ে উঠল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ছেলেটির কোনো নাম রাখা হয়নি।
নামবিহীন অবস্থায় কারো মারা যাওয়া উচিত নয়।
বাচ্চার মুখে আবার বাতাস ভরল ও। অন্ধের মতো পানির নিচে সাঁতরে এগোল। নিতান্তই ভাগ্যগুণে মোটাপিলারের আড়ালে আশ্রয় পেয়ে গেল টোলা।
বোট দুটো চলে গেছে, ওর আর দেরি করা চলবে না। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ওর। টোলা বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছে, ঠাণ্ডা পানির কারণেই এখনো বেঁচে আছে ও। কিন্তু সেই ঠাণ্ডা দুর্বল বাচ্চাটির জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
তীরের দিকে সাতারাতে শুরু করল টোলা। উনুতভাবে পা ছুড়ছে। দুর্বলতার কারণে সঠিকভাবে এগোতে পারছে না। বাচ্চাটিকে নিয়ে পানির নিচে ডুবে গেল টোলা।
না।
ডুব-সাঁতার দিয়ে এগোচ্ছে। হঠাৎ করে যেন খুব ভারী হয়ে গেছে পানি। বেশ যুদ্ধ করতে হচ্ছে পানির সাথে।
টোলা হার মানার পাত্রী নয়।
হঠাৎ একটা পাথরের সাথে বেমক্কা ধাক্কা খেল ওর পা। চিৎকার করে উঠল টোলা। ভুলে গিয়েছিল সে এখন পানির নিচে। হড়হড় করে নদীর পানি ওর মুখে ঢুকে গেল। পানির ভেতরে আরেকটু তলিয়ে গেল ও। শেষবারের মতো টোলা পা ছুঁড়তে শুরু করল। পানির নিচ দিয়ে তরতর করে এগিয়ে চলল ও।
খাড়া তীরের ছোঁয়া পেল পায়ের নিচে।
এক হাত আর হাঁটুর ওপর ভর করে পানি থেকে উঠে আসার চেষ্টা করল টোলা। গলার কাছে বাচ্চাটাকে ধরে রেখেছে। তীরে পৌঁছে মুখ থুবড়ে পড়ল ও। আর এক ইঞ্চিও সামনে এগোনোর শক্তি পাচ্ছে না। ওর রক্তে বাচ্চাটির শরীরে মাখামাখি হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে বাচ্চাটির দিকে তাকাল ও।
কোনো নড়াচড়া করছে না বাচ্চাটি। শ্বাসও নিচ্ছে না। একদম চুপচাপ।
চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করল টোলা।
কাঁদো, বাবু, একটু কাদো…
***
আওয়াজটা প্রথম শুনতে পান ফাদার ভেরিক।
তিনি আর তার ব্রাদাররা সেন্ট পিটার অ্যান্ড পল চার্চের একটা ভূগর্ভস্থ ওয়াইন। সেলারে আশ্রয় নিয়েছেন। গতকাল রাতে যখন ব্রিসলাউে বোমা হামলা শুরু হয়েছিল তখন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছেন, তাদের আইল্যান্ড যেন নিরাপদ থাকে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে এই চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। শহরের সীমানা নির্ধারণ করার সময় ভাগ্যগুণে রক্ষা পেয়েছিল চার্চটি। এখন আবার সেই স্বর্গীয় সৌভাগ্যের প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হয়েছে।
সেই আওয়াজ এবার দেয়ালে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করল।
ফাদার ভেরিক উঠে দাঁড়ালেন। বয়স হয়ে গেছে তাঁর, উঠে দাঁড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো।
“কোথায় যাচ্ছেন?” জানতে চাইল ফ্রানজ।
‘আমি একটু দেখে আসি বিড়ালগুলো বোধহয় ডাকছে,’ ফাদার জবাব দিলেন। গত দুই দশক ধরে নদীর পাড়ে থাকা বিড়াল ও বিভিন্ন সময় চার্চের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানন কুকুরদেরকে এটা সেটা খাইয়ে আসছেন ফাদার।
‘এখন সঠিক সময় না,’ আরেকজন ব্রাদার সতর্ক করলেন, তার কণ্ঠে ভয়।
মৃত্যুকে এখন আর ফাদার ভেরিক ভয় পান না। সেলার পেরিয়ে ছোট প্যাসেজে পা রাখলেন তিনি। প্যাসেজটা নদীর সামনে গিয়ে শেষ হয়েছে। অন্যসময় এই প্যাসেজে কয়লা দিয়ে সবুজ বোতল স্টোর করে রাখা হয়। যদিও বোতলগুলো এখন ওক গাছ আর ধুলোবালির ভেতর গড়াগড়ি খাচ্ছে।
পুরোনো দরজার কাছে পৌঁছে খিল তুলে দিলেন ফাদার।
কাজটা করার সময় এক কাধ দিয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। ক্যাচ ক্যাচ শব্দে আর্তনাদ করে উঠল পুরোনো দরজা।
প্রথমেই ধোয়া এসে তার মুখে আঘাত হানল। আবার হলো আওয়াজটা। শব্দের উৎসের খোঁজে নিচ দিকে তাকালেন ফাদার। “Mein Gott im Himmel”
একজন নারী দেহ পড়ে রয়েছে। কোনো নড়াচড়া নেই। তাড়াতাড়ি নারীর কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। নতুন এক প্রার্থনা করতে করতে হাঁটু গেড়ে বসলেন।
নারীর গলায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করলেন, এখনো বেঁচে আছে কি-না। কিন্তু ভেজা রক্ত ছাড়া আর কোনো সাড়া পেলেন না ফাদার। শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গেছে।