প্রথম বোট তীরে পৌঁছে গেছে। নিজের ভাবনার জাল ছিঁড়ে যাওয়ায় খুশিই হলো জ্যাকব। ইউনিটের সদস্যদেরকে চটজলদি দুটো বোটে উঠে পড়ার জন্য তাগাদা দিল সে।
কোলে বাচ্চাটিকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে টোলা। ওর পাশে একজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। সূর্যের আলোতে ঝকমকিয়ে ওঠা চার্চের চুড়ো দুটো ওর চোখেও পড়েছে। গোলাগুলি চলছে এখনো। ধীরে ধীরে গোলাগুলির আওয়াজ আরও কাছে আসছে। ট্যাংকগুলো এগোচ্ছে ধীর গতিতে, সেই শব্দও শোনা যাচ্ছে। চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ মিলেমিশে একাকার।
টোলা যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচরণের কথা বলে ভয় পাচ্ছিল সেই ঈশ্বর কোথায়?
নিশ্চয়ই এখানে নয়।
বোট ভরে যাওয়ার পর টোলার দিকে এগোল জ্যাকব। বোটে উঠন। কথাটা সে আরও কঠিনভাবে বলতে চাইলেও টোলার চেহারায় কিছু একটা ছিল যার কারণে ততটা কঠোরভাবে বলতে পারল না।
নির্দেশ মতো কাজ করল টোলা। দৃষ্টি এখনো ক্যাথেড্রালের দিকে। ওর চিন্তা ভাবনার সীমানা আকাশকেও ছাড়িয়ে গেছে।
ঠিক এই সময়ে জ্যাকব খেয়াল করে দেখল ডক্টর টোলা নারী হিসেবে কত সুন্দরী। হোক না আধা-ইহুদি। টোলা বোটে পা রাখল। একটু টলে উঠলেও সামলে নিল নিজেকে। বাচ্চার ব্যাপারে খুব সতর্ক রয়েছে। ধূসর পানি আর ধোয়ার চাদরের দিকে আবার তাকাল টোলা। পাথরের মতো শক্ত হলো ওর চোখ-মুখ। নিজের বসার জন্য সিট দেখার সময়ও ওর চোখে স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল।
স্টারবোর্ড বেঞ্চে গিয়ে বসল টোলা। ওর সাথে সাথে গার্ডও এগোল।
ওদের থেকে একটু তফাতে বসল জ্যাকব। বোটের পাইলটকে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিল। দেরি করা চলবে না। নদীতে চোখ বুলাল সে। পশ্চিম দিকে যাত্রা শুরু করছে ওরা। সূর্য উদয়ের দিক থেকে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে।
ঘড়ি দেখল জ্যাকব। এতক্ষণে নিশ্চয়ই এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে একটা পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ডে জার্মান জাঙ্কার জু-৫২ ট্রান্সপোর্ট প্লেন ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য জার্মান রেড ক্রস দিয়ে মেডিক্যাল ট্রান্সপোর্টের ছদ্মবেশ দেয়া হয়েছে ওটাকে।
বোট দুটো গভীর পানিতে নেমে গেল, ইঞ্জিনের গুঞ্জন বাড়ছে। রাশিয়ানরা এখন ওদেরকে আর আটকাতে পারবে না। মিশন কমপ্লিট।
বোটের দূরবর্তী প্রান্তে কিছু একটা নড়াচড়া করায় জ্যাকবের দৃষ্টি
সামনে ঝুঁকে বাচ্চাটির মাথায় গুচ্ছ খানেক চুলে আলতো করে চুমো দিল টোলা। মুখ তুলে জ্যাকবের চোখে চোখ রাখল ও। জ্যাকব ওর চোখে ঘৃণা কিংবা রাগ দেখতে পেল না। টোলার চোখের ভাষায় ছিল দৃঢ়সংকল্প।
টোলা এখন কী করতে যাচ্ছে সেটা জ্যাকব বুঝতে পেরেছিল। ‘না…।’
কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
পেছনে থাকা নিচু রেইলের দিকে ঝুঁকে পা ছুঁড়ে নিজেকে ওপরে তুলে দিল টোলা। বাচ্চাটাকে বুকের ভেতরে নিয়ে উল্টো দিকে ডিগবাজি খেয়ে ঠাণ্ডা পানিতে পড়ল।
আচমকা এরকম ঘটনায় একেবারে হকচকিয়ে গেছে টোলার গার্ড। হতভম্ব হয়ে পানিতে অন্ধের মতো গুলি করতে শুরু করল সে।
দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে গার্ডকে থামাল জ্যাকব। বাচ্চাটার গায়ে লেগে যাবে তো।
বোটের কিনারায় গিয়ে পানির ওপর সে অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলল। ওর ইউনিটের সদস্যরা উঠে দাঁড়াতেই দুলে উঠল বোট। জ্যাকব ধূসর পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না। বোটের পাইলটকে বৃত্ত রচনা করে পানির ওপর চক্কর দেয়ার নির্দেশ দিল সে।
কিছুই পাওয়া গেল না।
পানির নিচ থেকে ভেসে আসা বুদবুদ খুঁজছিল জ্যাকব, কিন্তু বোট বেশি ওজন হয়ে যাওয়ার ফলে পানিতে অতিরিক্ত টেউ খেলে যাচ্ছিল। বুদবুদ চোখে পড়ল না। রাগে, হতাশায় রেইলে ঘুষি মারল জ্যাকব।
যেমন বাবা… তেমন মেয়ে…।
একমাত্র আধা-ইহুদিরাই এরকম দুঃসাহসিক কাজ করতে পারে। জ্যাকব এর আগেও এরকম ঘটনা দেখেছে। মা তার নিজের সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে, যাতে সন্তানকে সামনে আরও বেশি কষ্ট ভোগ করতে না হয়। জ্যাকব ভেবেছিল, টোলা ওরকম নয়। মেয়েটার মন হয়তো আরও শক্ত। কিন্তু যা হওয়ার তা তো হলোই। হয়তো টোলার আর কোনো উপায় ছিল না। বাধ্য হয়ে কাজটা করেছে সে।
নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক সময় নিয়ে চক্রাকারে ঘুরল জ্যাকবের বোট! ওর ইউনিটের লোকেরা দু’পাশের তীরে সতর্ক দৃষ্টি রাখল। নেই। মাথার ওপর থেকে হু উস করে একটা মর্টার শেল উড়ে যেতে দেখে আর বেশি দেরি করল না ওরা।
ইউনিটের সবাইকে যার যার সিটে বসার নির্দেশ দিল জ্যাকব। পশ্চিম দিক দেখাল সে, ওখানে প্লেন অপেক্ষা করছে। ওদের কাছে এখনো প্রয়োজনীয় বাক্স ও কাগজ-পত্র আছে। টোলা আর বাচ্চাটা হাতছাড়া হওয়ায় দুটো ক্ষতি হয়েছে। টোলার বিকল্প না পাওয়া গেলেও বাচ্চার ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নেয়া যাবে। আরেকটা বাচ্চা নিয়ে গেলেই হলো।
‘চলো।‘ অর্ডার দিল জ্যাকব।
বোট দুটো আবার রওনা হয়ে গেল। ইঞ্জিন গর্জে উঠল পূর্ণ শক্তিতে।
ব্রিসলাউ পুড়ে তৈরি হওয়া ধোয়ার চাদরের ভেতরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল।
***
টোলা শুনতে পেল বোটের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
ক্যাথেড্রাল ব্রিজের একটা মোটা পিলারের আড়ালে পানিতে ভাসছে ও। এক হাতে বাচ্চাটির মুখ শক্ত করে চেপে ধরে আছে, যাতে কোনো শব্দ না হয়। মনে মনে আশা করছে, ছোট বাচ্চাটি যেন নাক দিয়ে যথেষ্ট বাতাস নিতে পারে। কিন্তু বাচ্চাটি বেশ দুর্বল।