‘দাও… দেখি,’ বলল টোলা। ওর কনুই ধরে ছিল একজন, তার কাছ থেকে জোর করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল ও। বাচ্চাটাকে আমার কাছে দিন।
জ্যাকবের দিকে তাকাল সৈনিক। ওদের মাথার ওপরে চলা বিস্ফোরণের বহর এখন থেমেছে। সব চুপচাপ। কিন্তু নিচে বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। মুখ কুঁচকে সায় দিল জ্যাকব।
টোলার কব্জিতে থাকা বাধন খুলে দেয়া হলো। নিজের আঙুলগুলোতে রক্ত সঞ্চালন করার জন্য ডলতে ডলতে বাচ্চাটির কাছে গেল ও। বাচ্চাকে টোলার কাছে দিয়ে ভারমুক্ত হলো সৈনিক। বাচ্চটিকে কোলে তুলে আস্তে আস্তে দোল খাওয়াতে শুরু করল টোলা। বাচ্চার দিকে ঝুঁকে ওকে আরও কাছে নিল ও। শিশুটির কানের কাছে টোলা ফিসফিস করে কী যেন বলতে শুরু করল। টোলার পুরো শরীর নরম হয়ে উষ্ণ আবেশে জড়িয়ে নিল বাচ্চাটিকে।
ধীরে ধীরে কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। বাচ্চাটি এখন চুপচাপ কাঁদছে।
সন্তুষ্ট হয়ে টোলার গার্ডের দিকে মাথা ঝাঁকাল জ্যাকব। টোলার পিঠে গ্যার ঠেকিয়ে ধরল গার্ড। বাচ্চার কান্না থেমেছে। এবার চুপচাপ ব্রিসলাউের ভূগর্ভস্থ টানেলের ভেতর দিয়ে এগোতে শুরু করল সবাই।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ড্রেনের নোংরা দুর্গন্ধের জায়গায় স্থান করে নিল ধোয়ার গন্ধ। জ্যাকবের হ্যান্ড-টর্চ স্টর্ম ড্রেনের শেষ প্রান্ত আলোকিত করল। কামান থেকে গোলাবর্ষণ থামলেও প্রায়ই গোলাগুলির আওয়াজ ভেসে আসছে পূর্বদিক থেকে। ধারে কাছে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
পেছনে থাকা সদস্যদের দিকে তাকাল জ্যাকব। ওদেরকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে রেডিওম্যানকে বলল, “বোটগুলোকে সিগন্যাল দাও।‘
কেতাদুরস্তভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে সামনে এগোল রেডিওম্যান। ধোয়ার ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। কয়েক মুহূর্তের ভেতরে লাইটের ফ্ল্যাশ ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তী আইল্যান্ডে সিগন্যাল আদান-প্রদান করা হয়ে গেল। জলপথটুকু পেরিয়ে জায়গামতো বোট পৌঁছুতে মিনিট খানেক সময় লাগবে।
টোলার দিকে তাকাল জ্যাকব। মেয়েটা এখনো বাচ্চাটিকে কোলে রেখেছে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে রয়েছে বাচ্চাটি।
জ্যাকবের চোখে চোখ পড়ল টোলার, দৃঢ়ভাবে বলল, “আপনি জানেন, আমার বাবা-ই ঠিক ছিলেন,’ এতটুকু বলে হঠাৎ চুপ মেরে গেল ও। সৈনিকদের কাছে থাকা বিভিন্ন সিলমারা বারের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আবার জ্যাকবের দিকে ফিরল টোলা। ‘আপনি আপনার চেহারা দেখেই সেটা বুঝতে পারছি। আমরা… আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছিলাম।’
‘আমি বা আপনি, আমাদের কেউ-ই ওরকম বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো অধিকার রাখি না,’ জ্যাকব জবাব দিল।
‘তাহলে কে রাখে?’
মাথা নাড়ল জ্যাকব, অন্যদিকে ঘুরতে শুরু। স্বয়ং হেনরিক হিমল্যার ওকে এই অর্ডার দিয়েছেন। এখানে জ্যাকবের কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। ও বুঝতে পারছে, টোলা এখনো ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘এটা ঈশ্বর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল,’ ফিসফিস করে বলল টোলা।
‘বোট চলে এসেছে,’ রেডিওম্যানের এই ঘোষণা জ্যাকবকে কোনো জবাব দেয়া থেকে বাঁচিয়ে দিল। রেডিওম্যান স্টর্ম ড্রেনের মুখ থেকে ফিরে আসছে।
নিজের লোকদের শেষবারের মতো নির্দেশ দিল জ্যাকব। সবাইকে জায়গামতো দাঁড় করালো। সামনে থেকে সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ও। এই টানেল ওদেরকে রিভার ওডের একটা ঢালু তীরে পৌঁছে দেবে। অন্ধকার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করছে। মিশনের জন্য এই অন্ধকার ওদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু উজ্জ্বল হয়ে উঠছে পুব আকাশ। তবে নদীর ওপরে ঝুলে থাকা ধোয়ার মেঘ পানিকে এখনো সূর্যের আলো থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই ধোয়ার ভারী চাদর ওদেরকে সাহায্য করতে পারে।
কিন্তু সেটা কতক্ষণ?
একটানা গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। ওগুলোকে পটকাবাজির মতো শোনাচ্ছে। যেন। ব্রিসলাউ শহরের ধ্বংস উপলক্ষে ফোঁটানো হচ্ছে ওগুলো।
দুর্গন্ধের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে জ্যাকব তার ওয়েট মাস্ক খুলে ফেলল। ফুসফুসে ভরে নিল তাজা বাতাস। সীসার মতো ধূসর পানিতে চোখ বুলাল ও। বিশ ফুটি দুটো বোট নদীর পানি কেটে তরতর করে এগিয়ে আসছে। মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটানা শব্দ করছে ওগুলোর ইঞ্জিন। বোট দুটোর অগ্রভাগে সবুজ তেরপলের নিচে কোনমতে লুকিয়ে রাখা হয়েছে একজোড়া এমজি-৪২ মেশিন গান।
বোটের পেছনে এইমাত্র আইল্যান্ডের একটা কালো অবয়ব ফুটে উঠল। ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড আসলে আক্ষরিক অর্থে কোনো দ্বীপ নয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাটি দিয়ে ভরাট করে এই দ্বীপের সাথে তীরের সংযোগ করে দেয়া হয়েছে। ওই শতাব্দীতেই ঢালাই লোহা দিয়ে তৈরি সবুজ রঙের একটা ব্রিজ তীরের সাথে দ্বীপের সংযোগ আরও উন্নত ও সহজ করে দিয়েছে। সেই ব্রিজের নিচ দিয়ে দুটো গানবোট এগিয়ে আসছে।
চার্চের দুটো টাওয়ারের চূড়োর দিকে তাকাল জ্যাকব। সূর্যের আলো এসে পড়ছে ওগুলোতে। এই গির্জার কারণেই দ্বীপের নাম ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড নামকরণ করা হয়েছিল। এই আইল্যান্ডে আধ ডজন চার্চ আছে।
টোলা হিরজফিল্ডের কথাগুলো এখনো জ্যাকবের কানে বাজছে।
এটা ঈশ্বর ও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করেছিল।
সকালের ঠাণ্ডা জ্যাকবের ভেজা কাপড়ের ভেতর সেঁধিয়ে পড়ছে। চামড়ায় গিয়ে বিঁধছে কাঁটার মতো। এখান থেকে চলে গিয়ে এই দিনগুলো ভুলে যেতে পারলে তৃপ্তি পাবে সে।