কিন্তু হিউগো হিরজফিন্ডকে হত্যা করার অর্ডারে স্বয়ং ফাহরির সাইন করেছেন। সেই অর্ডারে শুধু এই আধা-ইহুদি বাবার মেয়েই নয় জার্মানের মাঝখানে কোনো এক জায়গায় বসবাসরত একজোড়া বুড়ো বাবা-মা’কেও বাঁচিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শংকর জাতের ইহুদিদের প্রতি জ্যাকবের যতই অবিশ্বাস থাক না কেন ফাহরির নির্দেশ তাকে পালন করতেই হবে। অর্ডার পেপারে পরিষ্কার লেখা ছিল : পুরো মাইন খালি করতে হবে। রিসার্চের কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় রির্সোস রেখে বাকি সবকিছু ধ্বংস করতে হবে।
তারমানে ডক্টর টোলাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতেই হচ্ছে।
এবং একটা শিশুকেও বাঁচিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কাপড়ে প্যাঁচিয়ে একটা প্যাকে রাখা হয়েছে নবজাতকটিকে। ইহুদি শিশু। বয়স সর্বসাকুল্যে এক মাসের বেশি হবে না। বাচ্চাটিকে চুপ করিয়ে রাখার জন্য হালকা সিডেটিভ দেয়া হয়েছে।
বাচ্চাটি জ্যাকবের ঘৃণা ভরা মনে আকস্মিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। এই ইহুদি বাচ্চার ক্ষুদে হাতের ওপর নির্ভর করছে তৃতীয় নাৎসি প্রজন্ম। যদিও এধরনের চিন্তা একটু কঠিন। তারচেয়ে বরং বাচ্চাটাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলাই ভাল ছিল। কিন্তু জ্যাকবের এখানে কিছু করার নেই। সে নির্দেশ পালন করছে মাত্র।
ডক্টর টোলা বাচ্চাটির দিকে কীভাবে তাকাচ্ছে সেটা খেয়াল করেছে জ্যাকব। টোলার চোখে সে একই সাথে আগুন ও দুর্দশার ছাপ দেখতে পেয়েছে। বাবার রিসার্চ চালিয়ে নেয়ার পাশাপাশি ওকে বাচ্চাটির পালক মায়ের দায়িত্বও পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানো, খাওয়ানো এসব কাজ করতে হচ্ছে ওকে। এই বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়েই জ্যাকবের টিমের সাথে সহযোগিতা করছে টোলা। বাচ্চার প্রাণনাশের হুমকি দেয়ার পরেই টোলা ওদেরকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে।
ওদের মাথার উপরে মর্টার শেল বিস্ফোরিত হলো। হাঁটু টলে উঠল সবার। বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। সিমেন্টের পলেস্তরায় ফাটল ধরল, চুন, সুরকি পড়ল ড্রেনের নোংরা পানিতে।
কম্পনের ধাক্কা থেকে নিজেকে সামলে নিল জ্যাকব। পাশে এসে দাঁড়িয়ে পয়ঃনিষ্কাশন পাইপের সামনের দিকে থাকা একটা শাখার দিকে নির্দেশ করল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড, অসকার হেনরিকস।
‘স্যার, আমরা ওই টানেল ধরে এগোব। ওটা স্টর্ম ড্রেন, বেশ পুরোনো। মিউনিসিপ্যালের ম্যাপ বলছে, এটা নদীতে গিয়ে মিশেছে। ক্যাথেড্রাল আইল্যান্ড থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়।’
সায় দিয়ে মাথা নাড়ল জ্যাকব। আইল্যান্ডের কাছাকাছি কোথাও একজোড়া ছদ্মবেশী গানবোট অপেক্ষায় রয়েছে। ওখানে রয়েছে আরেকটা কমান্ডো ইউনিট। দূরত্বের হিসেবে এখান থেকে খুব একটা বেশি নয়।
মাথার উপরে মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণ করে রীতিমতো তুলকালাম চালাচ্ছে রাশিয়ানরা। জ্যাকব খুব দ্রুত সবাইকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চলল। সর্বনাশের মোলোকলা পূর্ণ করতে শহরে রাশিয়ানরা পাগলের মতো আক্রমণ করছে। শহরের বাসিন্দাদেরকে আত্মসমপর্ণ করতেই হবে, তাছাড়া কোনো উপায় নেই।
শাখা টানেলের কাছে পৌঁছেই জ্যাকব জলকপাটের নোংরা মই বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ওপরে ওঠার সময় তার জুতো থেকে প্যাঁচ-প্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। টানেলের ভেতরে থাকা তীব্র দুর্গন্ধে জ্যাকবের নাড়ি-ভূড়ি গলা দিয়ে উঠে আসে আসে অবস্থা। দুর্গন্ধ যেন মই বেয়ে ওর পেছন পেছন তাড়া করছে।
ইউনিটের বাকি সবাই ওর পথ অনুসরণ করল।
জ্যাকব ওর হ্যান্ড-টর্চ জ্বালিয়ে সিমেন্ট ড্রেনের দিকে তাক করল।
বাতাস থেকে এখনো দুর্গন্ধ কমেনি নাকি?
টর্চের আলোর রশ্মিকে সামনে রেখে নতুন উদ্যমে এগিয়ে গেল সে। আর একটু গেলেই পালানোর রাস্তা, মিশন প্রায় কমপ্লিট। রাশিয়ানরা ওয়েনসেলস্ মাইনে থাকা ইঁদুর দর্শন করতে পারার আগেই ওর ইউনিট সিলেসিয়ার অর্ধেক পথে থাকবে। রাশিয়ানদের স্বাগতম জানানোর জন্য জ্যাকব ল্যাবরেটরির প্যাসেজগুলোতে বুবি ট্র্যাপ বোম সেট করে এসেছে। যমদূতের দর্শন ছাড়া ওখানে রাশিয়ান আর তাদের মিত্রবাহিনীরা কিছুই পাবে না।
নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তাজা বাতাস টানতে টানতে এগিয়ে চলল জ্যাকব। এই সিমেন্ট টানেল তির্যকভাবে ঢাল তৈরি করে ধীরে ধীরে নেমে গেছে। জ্যাকবের ইউনিট এগোচ্ছে আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে। ওদের এগোনোর ফাঁকে ফাঁকে বোমা ফাটাচ্ছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। রাশিয়ানরা তাদের পুরো শক্তি নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। নদী কতক্ষণ ফাঁকা থাকবে সেটা বলা যাচ্ছে না।
বাচ্চাটি মৃদু স্বরে কান্না শুরু করল। হালকা ভোজের সিডেটিভের প্রভাব কেটে গেছে। জ্যাকব তার টিমের মেডিক্যাল সদস্যকে সাবধান করে দিয়েছিল, বাচ্চাটিকে যেন কড়া ডোজের সিডেটিভ না দেয়া হয়। বাচ্চার জীবন ঝুঁকিতে ফেলা চলবে না। কিন্তু হয়তো ওদের ভুল ছিল…
কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে।
উত্তর দিকে কোথাও একটা মর্টার শেল বিস্ফোরিত হলো।
বাচ্চার কান্নার ভলিউম এখন তুঙ্গে। টানেলের ভেতরে প্রতিধ্বনি করছে ওর কান্নার আওয়াজ।
‘বাচ্চাটাকে চুপ করাও!’ যে সৈনিক বাচ্চাটিকে নিয়ে এগোচ্ছিল তাকে নির্দেশ দিল জ্যাকব।
বাচ্চা রাখার প্যাকটা কাঁধ থেকে দ্রুত নামাতে গিয়ে হালকা গড়নের সৈনিকের মাথায় থাকা কালো ক্যাপ পড়ে গেল। বাচ্চাটিকে শান্ত করতে গিয়ে আরও কাঁদিয়ে ফেলল সে।