নিজের পেছনে থাকা অধীনস্থদের ওপরে গর্জে উঠল জ্যাকব। ওর ইউনিট হলো–স্পেশাল ইভ্যাকুয়েশন কমান্ডো। অর্থাৎ, জরুরি মুহূর্তে কোনো কিছু স্থানান্তর কিংবা অপসারণ করার কাজে ওর টিম দক্ষ।
হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাওয়ায় নোংরা পানি ঠেলে টিমের সদস্যরা জ্যাকবের পেছন পেছন আসছে। সংখ্যায় ওরা ১৪ জন। সবাই সশস্ত্র। সবার পোশক কালো। ভারী প্যাক বইছে সবাই। টিমের মাঝখানে অবস্থান করছে চারজন দীর্ঘাকায় সদস্য, এরা সবাই ইউরোপীয় সাবেক কম্যান, অতীতে বিভিন্ন জাহাজ ও বন্দরে পণ্য খালাস করার কাজ করে এসেছে। এদের কাঁধে রয়েছে ছিদ্রকারী পোল। বেজায় ওজন পোলগুলোর।
জার্মানি ও পোল্যান্ডের মধ্যে সাডেটেনে অবস্থিত এই নিঃসঙ্গ শহরে রাশিয়ানদের আক্রমণ করার একটা বিশেষ কারণ আছে। হাইল্যান্ডে যাওয়ার প্রবেশদ্বারে কড়া নিরাপত্তা পাহারা হিসেবে কাজ করছে ব্রিসলাউ’র দুর্গগুলো। বিগত দু’বছর ধরে নানান শ্রমিকদেরকে ধরে একটা পাহাড়ে গর্ত খোঁড়ার কাজে জড়ো করা হয়েছে গোসরোজেন ক্যাম্পে। তাদেরকে দিয়ে ১০০ কিলোমিটার টানেল খুড়িয়ে তারপর সেটাকে ধসিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এসব কাণ্ড করা হয়েছে একটা গোপন প্রজেক্টকে মিত্রবাহিনীর লোপ চোখ থেকে আড়াল করার জন্য।
ডাই রেইজ… দ্য জায়ান্ট।
কিন্তু এত কাজ করেও ঘটনা পুরোপুরি গোপন করা যায়নি। ওয়েনসেলস্ মাইনের বাইরের কোনো এক গ্রামের বাসিন্দারা অদ্ভুত সব রোগ নিয়ে কানাঘুষা করেছিল। রহস্যময় রোগগুলো শুধু সেই বিশেষ এলাকার বাসিন্দাদেরকেই ভোগায়নি, যারা পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাস করতো তাদেরকেও ভুগিয়েছে।
যদি প্রজেক্টের বিজ্ঞানীরা তাদের রিসার্চ সম্পন্ন করার জন্য আরও সময় পেতেন…
জ্যাকবের মনের এক অংশে এখন সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। গোপন সেই প্রজেক্ট সম্পর্কে সে আসলে সবকিছু জানতে পারেনি। অধিকাংশই হলো কোড নেম। যেমন : ক্রোনস। তবে সে যতটুকু জানতে পেরেছে সেটাও নেহাত কম নয়। প্রজেক্টের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত বডি দেখেছে সে। তাদের চিৎকার শুনেছে।
বিভীষিকা!
জ্যাকবের মনে ওই একটা শব্দ এলো। পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা ভাবতেই যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর রক্ত।
বিজ্ঞানীদের পরপারে পাঠাতে ওর কোনো সমস্যা হয়নি। ৬২ জন পুরুষ ও এক নারীকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দু’বার করে মাথায় বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ওয়েনসেলস মাইনের গভীরে কী হচ্ছিল… কিংবা এখানে এসে কী পাওয়া গিয়েছিল সেটা কারো জানা চলবে না। শুধু একজন গবেষককে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।
ডক্টর টোলা হিরজফিল্ড।
জ্যাকব শুনতে পেল ওর পেছন পেছন আসতে টোলা হিরজফিল্ড গাইগুই করছে। অনেকটা টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে আসা হচ্ছে তাকে। দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। ডক্টর টোলা মেয়ে হিসেবে বেশ লম্বা। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ওর স্তনগুলো ছোট হলেও প্রশস্ত কোমর আর পা দুটো বেশ সুগঠিত। চুলের রং কালো, মসৃণ। তিন মাস মাটির নিচে, সংরক্ষিত দুধের মতো ফ্যাকাসে রঙের ত্বক ওর। অন্য সবার সাথে ওকেও মেরে ফেলা হতো কিন্তু বাবা হিউগো হিরজফিল্ডের কারণে বেঁচে যাচ্ছে ও। প্রজেক্টের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন হিউগো। কিন্তু তার রক্তে দুর্নীতির কণা বইছে, একদম শেষ মুহূর্তে এসে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। ইহুদির রক্ত বইছে তার শরীরে। নিখাদ ইহুদি হলে এক কথা ছিল কিন্তু তিনি হলেন শংকর জাতের ইহুদি। যাকে বলে, আধা-ইহুদি। নিজের রিসার্চের যাবতীয় ফাইল ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন হিউগো কিন্তু অফিসে আগুন লাগানোর আগেই একজন গার্ড তাকে গুলি করে। তার মেয়ের কপাল ভাল, এই রিসার্চ সম্পর্কে পুরো জ্ঞান আছে ওর। ডক্টর টোলা রিসার্চের কাজগুলো চালিয়ে যেতে পারবে। বাবার মতো মেয়েও অনেক মেধাবী। এখানকার অন্য কোনো বিজ্ঞানীর চেয়ে টোলা ওর বাবার রিসার্চ সম্পর্কে বেশি জ্ঞান রাখে।
কিন্তু ওকে ভয় না পাইয়ে প্রলোভন দেখিয়ে এখান থেকে নিয়ে গেলেই বরং ভাল হতো।
যখনই টোলার দিকে তাকাচ্ছে তখনই ওর চোখে ঘৃণার আগুন দেখতে পাচ্ছে জ্যাকব। ওর সেই ঘৃণার উত্তাপ জ্যাকব বেশ ভাল করে টের পাচ্ছে। সমস্যা নেই, মেয়েটা ঠিক ওর বাবার মতো সহযোগিতা করবে। ইহুদিদের সাথে কীভাবে চলতে হয় সেটা জ্যাকবের ভাল করেই জানা আছে। বিশেষ করে এরকম আধা-ইহুদিদের ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ।
শংকর জাত।
আধা-ইহুদি, এরা সবচেয়ে জঘন্য। জার্মানির সেনাবাহিনীতে প্রায় লাখ খানেক আধা-ইহুদি আছে। ইহুদিদের চেয়ে আধা-ইহুদিদের একটু বেশিই খাটতে হয়। কোনো ক্ষেত্রে জীবন দেয়ার প্রয়োজন হলে সেখানে এইসব আধা-ইহুদিদেরকে পাঠানো হয়ে থাকে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সময়ও বাড়তি পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হয় আধা-ইহুদিদের। তাদেরকে প্রমাণ করতে হয়, সৈন্য হিসেবে তারা অনেক কঠোর ও হিংস্র, জার্মান সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য ইহুদিদের চেয়েও বেশি।
যতই আনুগত্যের পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে আসুক না কেন, জ্যাকব কখনো এসব আধা-ইহুদিদেরকে বিশ্বাস করে না। টোলার বাবা-ই জ্যাকবের অবিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করে দিয়েছেন। হিউগোকে রিসার্চের যাবতীয় তথ্য ধ্বংস করার চেষ্টা করতে দেখে জ্যাকব মোটেও অবাক হয়নি। ইহুদিদের কখনো বিশ্বাস করতে নেই, ওদেরকে শেষ করে দিতে হয়।