লকড।
ওদের দুজনকে এখন আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না। পেইন্টারের বুকে কপাল ঠেকিয়ে রেখেছে লিসা। প্রার্থনা করার জন্য বিশেষ কোনো পন্থা অবলম্বন করার প্রয়োজন নেই ওর। একটা কথা আছে, খুব বেকায়দায় পড়লে নাকি কেউ-ই আর নাস্তিক থাকে না। বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা সেরকম। তবে লিসা জানে না ঠিক কোন ঈশ্বরের কাছে ও প্রার্থনা করবে।
বিবর্তন ও ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন সম্পর্কে অ্যানার কথাগুলো লিসার মনে পড়ল। তার ভাষ্য অনুযায়ী কল্পনা করল লিসা।
অ্যামিনো অ্যাসিড… প্রথম প্রোটিন… প্রথম জীবন… চেতনা
কিন্তু চেতনা-এর পর কী আছে? এভাবে কতদূর? শেষটা কোথায়?
অ্যামিনো অ্যাসিড… প্রথম প্রোটিন… প্রথম জীবন… চেতনা…???
অ্যানার আরেকটা কথা মনে পড়ল লিসার। এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরের হাত কোথায় ও জানতে চেয়েছিল। জবাবে অ্যানা বলেছিলেন, আপনি ভুল দিকে, ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবছেন। লিসা তখন ভেবেছিল মহিলা হয়তো শান্তিতে ভুল বকছে। কিন্তু এখন ওর মনে হচ্ছে, অ্যানার মনেও হয়তো একই প্রশ্ন জেগেছিল। বিবর্তনের শেষে কী আছে? কী হবে? কোনো একটা নিখুঁত কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্র থাকবে তখন?
আর যদি তাই হয়, তাহলে সেটাই কী ঈশ্বর?
লিসা পেইন্টারের বুকে মাথা রেখেছে, ওর কাছে এসবের কোনো জবাব নেই। ও শুধু এতটুকুই জানে পেইন্টারকে জীবিত দেখতে হবে। হয়তো অন্য সবার আড়ালে লিসা নিজের আবেগ, অনুভূতি আর ভালবাসাকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে কিন্তু নিজের কাছ থেকে নিজের কাছ থেকে আর ওগুলোকে লুকোতে পারবে না।
নিজের হৃদয়ের দুয়ার খুলে দিলো লিসা। যত আবেগ আছে সব বেরিয়ে আসতে দিলো। বেল-এর গুঞ্জন আর আলো বাড়ছে। বাড়ক।
হয়তো এতদিন এই বিষয়টাই ওর জীবনে অনুপস্থিত ছিল। এজন্য হয়তো পুরুষ মানুষকে ওর কাছে অত ইন্টারেস্টিং লাগতো না। কোনো সম্পর্ক টিকাতে পারছিল ও। কারণ, পেশাগত ব্যস্ততা আর বাহ্যিক সৌজন্যতাবোধের আড়ালে ও নিজের হৃদয়কে, নিজের মনকে আড়াল করে রেখেছিল। তাই এত বয়স হয়ে যাওয়ার পরও পাহাড়ের ওপরে পেইন্টার যখন ওর জীবনে আসে তখনও একা ছিল ও। কোনো জীবনসঙ্গী ছিল না।
কিন্তু আর একা থাকা নয়।
মাথা উঁচু করল লিসা, সামনে সরাল। আস্তে করে চুমো খেলো পেইন্টারের ঠোঁটে। এই আবেগটাই লুকিয়ে রেখেছিল ও।
আর দশ সেকেন্ডের মধ্যে বেল ডিসচার্জ করবে। চোখ বন্ধ করল লিসা। মন খুলে প্রার্থনা করতে শুরু করল পেইন্টারের জন্য। সুন্দর ভবিষ্যৎ, সুস্থ-সবল দেহ আর ওর সাথে আরও কিছু সময় কাটানোর জন্য প্রার্থনা করল।
এটাই কী বেল-এর বিশেষ দিক? একটা কোয়ান্টাম নালার ভেতর দিয়ে কোয়ান্টাম পরিমাপক যন্ত্রকে বিবর্তনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেয়া, মূল নকশাকারীর সাথে একটা ব্যক্তিগত সংযোগস্থাপন করা।
লিসা জানে ওকে কী করতে হবে। নিজের ভেতরে থাকা বিজ্ঞানমনস্ক সত্তা ও নিজের সহজাত স্বভাবকে দূর করে দিলো। চেতনা কিংবা প্রার্থনা নয়…
এটা স্রেফ বিশ্বাস আর আস্থার বিষয়।
এরকম মুহূর্তে চোখ ধাঁধানো আলো বিচ্ছুরিত হলো বেল থেকে। লিসা আর পেইন্টারকে একত্রিত করে দিলো সেটা। বাস্তবতা রূপান্তরিত হতে শুরু করল নিখুঁত সম্ভাবনায়।
.
বিকাল ৩টা ৩৬ মিনিট।
সুইচ চাপল গ্রে, শিল্ড নিচে নামতে শুরু করল। দম নিতে ভুলে গেল সবাই। কী দেখতে পাবে ওরা? মোটরের গুঞ্জন থেমে গেছে। সবাই শিন্ডের দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
চিন্তিত চোখে ওর দিকে তাকাল মনক।
নিস্তবতার মাঝে ছোট্ট তীক্ষ্ণ একটা শব্দ আসছে বা পাশ থেকে। ধীরে ধীরে ব্লাস্ট চেম্বার দেখতে পেল ওরা। বেল এখন চুপ করে রয়েছে। অন্ধকার, স্থির হয়ে আছে। এরপরে ওরা লিসাকে দেখতে পেল। পেইন্টারের ওপর ঝুঁকে আছে সে। ওর পিঠটা ওদের দিকে ঘোরানো।
কেউ কিছু বলল না।
আস্তে আস্তে ঘুরল লিসা। মাথা তুলল। ওর চোখের পানি গড়িয়ে গাল ভিজিয়ে দিয়েছে। পেইন্টারকে ধরে তুলল ও। পেইন্টারকে দেখতে এখনও আগের মতো ফ্যাকাসে আর দুর্বল লাগছে। তবে সে ঠিকই গ্রেকে চিনতে পারল।
চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও সজাগ।
স্বস্তির পরশ বয়ে গেল গ্রের শরীরে।
সেই তীক্ষ্ণ শব্দটা শোনা গেল আবার।
চট করে সেদিকে তাকাল পেইন্টার ক্রো… তারপর গ্রের দিকে ফিরল। ঠোঁট নাড়াল কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। ভাল করে শোনার জন্য ক্রোর কাছে এগিয়ে গেল গ্রে।
চোখ সরু করে কঠিন দৃষ্টিতে ক্রো ওর দিকে তাকাল। বলার চেষ্টা করল আবার। খুব নিচু লয়ে একটা শব্দ বেরোল এবার। কিন্তু সেটা অর্থবহ নয় বোধহয়। গ্রে ভাবল পেইন্টারের মানসিক অবস্থা পুরোপুরি ভাল নয়।
বোম… আবার বলল ক্রো।
এবার লিসাও ওর কথা শুনতে পেয়েছে। পেইন্টার যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিকে তাকাল ও। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গের লাশ রয়েছে ওখানে। পেইন্টারকে নিয়ে মনকের দিকে এগোল লিসা।
ওকে ধরুন।
বুড়ো ওয়ালেনবার্গের দিকে এগোল ও। ব্যালড্রিক ওয়ালেনবার্গ অবশেষে তার। দেহ শ্রাগ করেছেন।
লিসার সাথে গ্রেও যোগ দিলো।
হাঁটু গেড়ে বসল লিসা, বুড়োর হাতা সরাল। কব্জিতে বড় একটা ঘড়ি পরে আছেন ব্যালড্রিক। ঘড়িটা নিজের দিকে ঘোরাল লিসা। ডিজিটাল ফরম্যাটে সেকেন্ড কাউন্ট ডাউন হচ্ছে।
আমরা এর আগেও এটা দেখেছি, বলল লিসা। হৃদপিণ্ডের সাথে মাইক্রোট্রান্সমিটার জুড়ে দেয়া থাকে। হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলেই উল্টোদিকে কাউন্ট শুরু হয়।