‘আপনি বরং এখানেই থাকুন,’ সিট বেল্ট খুলতে খুলতে লিসাকে বললেন আং গেল। আমরা মঠ পরীক্ষা করে আসি।
নিজের মেডিক্যাল প্যাক তুলে নিল লিসা। মাথা নেড়ে বলল, “আমি ভয় পাই না। আর আপনাদের সাথে গেলে হয়তো আমি কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব।’
নড় করলেন আং গেলু, হড়বড় করে কী যেন বললেন সৈনিককে। সশব্দে হেলিকপ্টারের পেছনের হ্যাঁচ খুলে নিচে নামলেন। এক হাত বাড়িয়ে দিলেন লিসার দিকে।
রোটরের ঝাপটার সহায়তায় ঠাণ্ডা হাওয়া হেলিকপ্টারের উষ্ণ শরীরের ভেতরে ঢুকে পড়ল। মাথায় পারকা’র হুড তুলে দিয়ে লিসা টের পেল এখানে যতই ঠাণ্ডা পড়ক অক্সিজেন এখনও আছে। তবে এমনও হতে পারে, ভয়ে ঠাণ্ডা লাগছে ওর। খানিক আগে ওর মুখ থেকে বেরোনো কথাটা একটু বাড়িয়েই বলা ছিল।
সন্ন্যাসীর হাত ধরল ও। পশমি হাতমোজা থাকার পরও টের পেল সন্ন্যাসী বেশ শক্তিশালী এবং হাত বেশ উষ্ণ। পরিষ্কার করে কামানো মাথা ঢাকার কোনো প্রবণতা দেখা গেল না তার মধ্যে। এরকম হিম শীতল ঠাণ্ডায় তিনি অভ্যস্ত।
হেলিকপ্টার থেকে নামার পরও রোটরের বাতাসের নিচে দাঁড়িয়ে রইল লিসা। সবশেষে নামল সৈনিক। পাইলট নামেনি। নির্দেশ অনুযায়ী বাধ্য হয়ে এখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করিয়েছে ঠিকই কিন্তু ককপিট ছাড়তে রাজি নয়।
হ্যাচ বন্ধ করে দিলেন আং গেলু। আলুর ক্ষেত পেরিয়ে পাথুরে ভবনগুলোর দিকে দ্রুত এগোল ওরা তিন জন।
ওপর থেকে লাল টালিঅলা ভবনগুলো দেখতে যতটা লম্বা মনে হচ্ছিল নিচে নেমে দেখা গেল ওগুলো তারচেয়েও লম্বা। মাঝের ভবনটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওটা তিন তলার মতো উঁচু। প্যাগোডার মতো ছাদ আছে ওতে। সব ভবন বেশ সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। দরজা, জানালার কাঠামোর চিত্রে রংধনুর রং ব্যবহার করা হয়েছে। সোনালি রঙের লতা-পাতা আঁকা আছে দরজার সরদলে। ছাদের কোণা থেকে নেমে এসেছে পাথরের ড্রাগন আর পৌরাণিক পাখি। ছাদযুক্ত দ্বার-মণ্ডপ আরও কয়েকটা ভবনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে একটু উঠোন ও ব্যক্তিগত জায়গা করে দিয়েছে। কাঠের তৈরি প্রার্থনার চাকায় খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন হরফ। বিভিন্ন রঙের প্রার্থনা পতাকা ঝুলছে ছাদ থেকে। বাতাসের কারণে থেমে থেমে দুলছে ওগুলো।
সাঙরিলা নামের পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই ভবনগুলো দেখতে অনেকটা রূপকথার মতো মনে হচ্ছে। লিসা খেয়াল করে দেখল এসব দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে পা ফেলছে ও। কোনোকিছু নড়ছে না। বন্ধ করা রয়েছে অধিকাংশ জানালা। নীরবতা একদম জেঁকে বসেছে।
বাতাসে কেমন যেন একটু দুর্গন্ধ পাওয়া গেল। গবেষক হওয়ার আগে লিসা যখন মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ছিল তখন থেকেই মৃত জিনিসগুলোর সাথে তার ওঠা-বসা। মৃত জিনিসের দুর্গন্ধ সে এখনও ভোলেনি। ও প্রার্থনা করল, গন্ধটা যেন মাঠের এই গবাদি পশুদের হয়। কিন্তু এখানে কারও চিহ্ন না দেখে খুব একটা আশাবাদী হতে পারল না লিসা।
সৈনিককে সাথে নিয়ে আং গেলু পথ দেখাচ্ছেন। ওদের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য দ্রুত পা চালাল লিসা। দুটো ভবন পার হয়ে ওরা এখন মাঝখানে দাঁড়ানো ভবনের দিকে এগোচ্ছে।
মূল উঠোনে বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি কেমনভাবে যেন ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় রয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফেলে গেছে কেউ। দু’চাকার একটা গাড়ির সাথে বাঁধা অবস্থায় রয়েছে ইয়াক। গাড়ি উল্টো হয়ে রয়েছে, মারা গেছে জন্তুটা। এটার পা-গুলোও শক্ত হয়ে ছড়িয়ে আছে, ফুলে গেছে পেট। দুধ সাদা চোখ মেলে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে প্রাণহীন দেহ। কালো দুই ঠোঁটের ভেতর দিয়ে ওর ফোলা জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে।
লিসা খেয়াল করে দেখল মৃতদেহের কাছে মাছি কিংবা অন্য কোনো ছোট কীট পতঙ্গের আনাগোনা নেই। পাহাড়ের এত উঁচুতে কী মাছি থাকে? ও সঠিক জানে না। আকাশের দিকে তাকাল লিসা। কোনো পাখি নেই। বাতাসের শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই।
‘এই দিকে,’ বললেন আং গেলু।
কয়েকটা লম্বা দরজার দিকে এগোলেন সন্ন্যাসী! দরজাগুলো পেরিয়ে ভবনের মাঝখানে অর্থাৎ মঠের মূল কেন্দ্রে যাওয়া যাবে। হাতল ধরে পরীক্ষা করে দেখলেন ওটা তালাবন্ধ নয়, খোলা। তিনি দরজা খুললেন, কজাগুলো ঝাঁকিয়ে উঠল।
দরজার ওপাশে প্রথম প্রাণের চিহ্ন মিলল। দরজার দু’পাশে ব্যারেল সদৃশ বাতি জ্বলছে। ডজনখানেক মোমবাতি জ্বলছে ওগুলোর সাথে। বাতিগুলো মাখনের সাহায্যে জ্বলে। ইয়াকের মাখন। কিন্তু ভেতরে সুগন্ধের বদলে আরও বেশি দুর্গন্ধ পাওয়া গেল। এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
এমনকী সৈনিকটিও এখন দরজার চৌকাঠের কাছ থেকে পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। তার অটোমেটিক ওয়েপনকে এক কাধ থেকে আরেক কাঁধে স্থান বদল করল, নিজেকে নিশ্চিত করল আরকী। সন্ন্যাসী অবলীলায় ভেতরে পা চালালেন। শব্দ করে ডাকলেন তিনি। প্রতিধ্বনিত হলো তার আওয়াজ।
আং গেলুর পেছন পেছন প্রবেশ করল লিসা। সৈনিকটি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
আরও কয়েকটা ব্যারেল বাতি জ্বলে উঠে আলোকিত করল মন্দিরের ভেতরটা। ঘরের দু’পাশের দেয়ালে প্রার্থনার চাকা সারিবদ্ধ করে রাখা। জুনিপারের সুগন্ধীযুক্ত মোমবাতি আর ধূপকাঠি জ্বলছে সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি আট ফুট উঁচু বুদ্ধ মূর্তির কাছে। বাকি দেবতাগণ তার কাঁধের পেছনে জায়গা করে নিয়েছে।