এত উজ্জ্বল আলো থেকে বাঁচতে চোখ পিট পিট করল লিসা। মূল দুনিয়াকে ছেড়ে এসে এখানে বাস করে কারা? এরকম বৈরি পরিবেশে কারা থাকে? আরাম ও ভাল জায়গা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কেন এরকম দুর্গম এলাকাকে বেছে নেয়?
এই প্রশ্ন লিসাকে ওর মা প্রায়ই জিজ্ঞেস করত। কেন এত কষ্ট করা? রিসার্চ শিপে পাঁচ বছর কাটানো, তারপর পাহাড়ের কঠিন পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য এক বছর ট্রেনিং নেয়া আর এখন নেপালে এভারেস্টে ওঠার পায়তারা! আরামের জীবনকে পায়ে ঠেলে এত ঝুঁকি নেয়া কেন?
একদম সাদামাটা জবাব ছিল লিসার : কারণ এখানে চ্যালেঞ্জ আছে। পর্বতারোহণের কিংবদন্তী জর্জ ম্যালেরিকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তিনি এভারেস্টে চড়েছেন, তখন কী তিনি এরকম জবাব দেননি? এভারেস্ট ছিল তাই চড়েছি। প্রশ্নাঘাত করতে ওস্তাদ সাংবাদিকের মুখের ওপর এই বিখ্যাত লাইনকে জবাব হিসেবে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন তিনি। মায়ের প্রশ্নের বিপরীতে লিসার জবাবও কী একেবারে মোক্ষম ছিল না? এখানে কী করছে লিসা? জীবনে প্রতিদিন নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। জীবিকা নির্বাহ করা, অবসরের জন্য সঞ্চয় করা, ভালবাসার মানুষকে খুঁজে বের করা, বিপদ-আপদকে মোকাবিলা করা, সন্তান মানুষ করা ইত্যাদি।
ভাবনার ঘুড়ি উড়ানো বন্ধ করল লিসা। হঠাৎ এক ধরনের উপলব্ধি হলো ওর। প্রকৃত জীবনকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি কোনো ভিন্ন জীবনের পেছনে ছুটছি না তো? এজন্যই কী আমার জীবনে এত পুরুষ আসা সত্ত্বেও কেউ নোঙর ফেলেনি?
লিসার বয়স এখন তেত্রিশ। একা, কোনো বাধন নেই, প্রত্যাশা নেই। একজন মানুষ ঘুমাতে পারবে এরকম স্লিপিং ব্যাগে একা একা রাত কাটিয়ে কোম্পানির জন্য গবেষণা করে যাচ্ছে। মাথার চুল কামিয়ে এরকম একটা পাহাড়ি মঠে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়াটাই বোধহয় ওর জন্য ভাল হবে।
কেঁপে উঠল হেলিকপ্টার, একটু খাড়া হয়েছে।
চিন্তার জাল ছিঁড়ে বাস্তবে ফিরল লিসা।
ওহ, শিট…
দম আটকে ফেলল ও। পাহাড়ের বিপজ্জনক রিজু এর ওপর দিয়ে আলতো করে ভেসে গেল হেলিকপ্টার। কোনোমতে পাশের একটা গিরিসঙ্কটের সাথে সংঘর্ষ এড়াল এটা।
সিটের হাতলকে শক্ত করে চেপে ধরছে ওর আঙুলগুলো। আঙুলের চাপ হালকা করার চেষ্টা করল ও। হঠাৎ ওর মনে হলো, তিন বেডরুমের একটা কটেজ আর আড়াইটা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে জীবন কাটালে মন্দ হয় না!
লিসার পাশে থাকা আং গেলু সামনে ঝুঁকে পাইলট আর সৈনিকের দিকে তাকিয়ে নিচের দিকে ইশারা করে নির্দেশ দিলেন। রোটরের আওয়াজে তার মুখের কথা ঢাকা পড়ল।
বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য জানালার কাঁচের সাথে নিজের গাল ঠেকাল লিসা। আলতো করে বাঁকানো প্লেক্সিগ্লাস ওর নরম গালে চুমো খেল। প্রথমবারের মতো নিচে একটু রঙের আভাস দেখা যাচ্ছে। লাল টাইলের ছাদ। আটটা পাথরের ভবন চোখে পড়ল। ওটার তিনদিকে দাঁড়িয়ে আছে বিশ হাজার ফুটি পাহাড়। আর একদিক আগলে রেখেছে পাহাড়ের খাড়া কিনারা।
টেম্প ওচ মঠ।
অত্যন্ত খাড়াভাবে ভবনের দিকে নামতে শুরু করল হেলিকপ্টার। লিসা খেয়াল করল একপাশে একটা আলুর ক্ষেত আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু গবাদি পশু আর গোলাঘর চোখে পড়ল। সব কেমন চুপচাপ। যান্ত্রিক পাখিতে চড়ে আসা অতিথিদেরকে স্বাগত জানাতে কেউ এগিয়ে এল না।
তারচেয়েও অলক্ষুণে ব্যাপার খেয়াল করল লিসা, কিছু ছাগল আর নীল রঙের ভেড়া রয়েছে গবাদি পশুর মধ্যে। ওগুলোও নড়াচড়া করছে না। মনে হচ্ছে, হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে ঘাবড়ে গিয়ে ভয়ে শক্ত হয়ে গিয়েছে। ভূমিতে পড়ে আছে ওগুলো, পাগুলো মোচড় খেয়ে রয়েছে, ঘাড় বাঁকা, একদম অস্বাভাবিক অবস্থা।
আং গেলু-ও এসব দেখে নিজের সিটে বসলেন। লিসার চোখে চোখ পড়ল তার। কী হয়েছে? সামনে পাইলট আর সৈনিকটির মধ্যে কোনো একটা বিষয় নিয়ে মত বিরোধ চলছে। পাইলট এরকম জায়গায় হেলিকপ্টার নামাতে চাইছে না। কিন্তু জয় হলো সৈনিকের। কারণ সে পাইলটের পাছায় রাইফেলের নল ঠেসে ধরেছে। ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের নাকে-মুখে অক্সিজেন মাস্ক আরো জোরে চেপে ধরল পাইলট। মাস্ক চেপে ধরার পেছনে রাগ আর বাতাসের প্রয়োজনের চেয়ে ভয়ের প্রভাবটাই বেশি।
সৈনিকের কথা মতো চলছে পাইলট। কন্ট্রোলের গলা টিপে ধরে হেলিকপ্টারকে ভূমিতে নামাতে শুরু করল। গবাদি পশুরগুলোর কাছ থেকে যতটা সম্ভব দূরে নামবে সে। মঠের পাশে থাকা আলু ক্ষেতের প্রান্তকে স্থির করল লক্ষ্য হিসেবে।
চারদিকে পাহাড়বেষ্টিত সমতল ভূমিতে সারি সারি অবস্থায় ক্ষেতটা গড়ে উঠেছে। সদ্য গজানো সবুজ অঙ্কুরে সেজেছে ক্ষেত। পাহাড়ের এত উঁচুতে আলু চাষ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল ব্রিটিশরা, উনবিংশ শতাব্দীতে। তারপর থেকে আলু এরকম অঞ্চলের জন্য একটি অপরিহার্য শস্যে পরিণত হয়।
বেমক্কা ঝাঁকি খেয়ে পাহাড়ি ভূমিতে অবতরণ করল হেলিকপ্টার। নামতে গিয়ে বেশ কয়েকটা চারা গাছ নষ্ট করেছে, সেটা বলাই বাহুল্য। রোটরের বাতাসের তোপে অঙ্কুরগুলো থরথর করে কাঁপছে।
এখনও কেউ তাদের আগমন সম্পর্কে হাজিরা দেয়নি। মৃত গবাদিপশুর কথা ভাবল লিসা। বাঁচানোর মতো কেউ কী এখানে আছে? নাকি সবাই মরে গেছে? কী হয়েছে এখানে? সম্ভাব্য বিভিন্ন কারণ ওর মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। খাদ্যে বিষক্রিয়া, বিষাক্ত বাতাস, ছোঁয়াচে কোনো রোগ কিংবা কোনো সংক্রামক? জানতে হলে ওর আরও তথ্য প্রয়োজন।