পাইলট ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। কোপাইলটের সিটে বসল সৈনিক। বুদ্ধ সন্ন্যাসী, নিজেকে আং গেলু নামে পরিচয় দিয়েছেন, লিসার সাথে ব্যাকসিটে বসলেন তিনি।
কানে শব্দ নিরোধক হেডফোন পরল লিসা। হেলিকপ্টারের ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে রোটর ঘোরার গতি বেড়ে গেল। হালকা বাতাসে ভর দিয়ে উঠতে গিয়ে দ্রুত উপর-নিচ দুলে উঠল যান্ত্রিক পাখি! সাবসনিক ধরনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে
অবশেষে পাথুরে ভূমি ছাড়ল হেলিকপ্টার। দ্রুত উপর দিকে উঠতে লাগল।
গিরিসঙ্কটের ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারটা যখন বাঁক নিচ্ছিল তখন লিসার মনে হলো ওর পাকস্থলী বোধহয় নাভির নিচে নেমে গেছে। জানালা দিয়ে নিচে তাকাল ও। তাবু ও ইয়াকগুলোকে দেখতে পেল। জশকে দেখল, একটি হাত উঁচু করে রেখেছে। বিদায় জানাচ্ছে নাকি সূর্যের আলো থেকে চোখ আড়াল করার জন্য হাত তুলেছে? জশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাসকি শেরপা। কাউবয় হ্যাঁটের কারণে তাকে হেলিকপ্টার থেকেও সহজে চিহ্নিত করা গেছে।
কিছুক্ষণ আগে শেরপা আকাশ দেখে যা বলেছিলেন সেটা আবার মনে হতেই লিসার চিন্তা-ভাবনাগুলো যেন বরফে জমে গেল।
বাতাসের পিঠে মৃত্যু ভর করেছে।
এই মুহূর্তে চিন্তাটা মোটেও সুখকর নয়।
লিসার পাশে ঠোঁট নাড়িয়ে নীরবে প্রার্থনা করছেন বুদ্ধ সন্ন্যাসী। কীসের ভয়ে প্রার্থনা করছেন তিনি? এই হেলিকপ্টারে চড়ার ভয় নাকি মঠে গিয়ে কী অবস্থা দেখবেন সেটার ভয়?
পেছনে হেলান দিল লিসা। শেরপার কথাটা এখনও ওর কানে বাজছে।
আজকের দিনটা সত্যিই খারাপ।
.
সকাল ৯টা ১৩ মিনিট।
উচ্চতা : ২২ হাজার ২৩০ ফিট।
বড় বড় পা ফেলে গভীর ফাটলযুক্ত অঞ্চল অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে সে। স্টিলের ক্রাম্পগুলো সেঁধিয়ে যাচ্ছে তুষার ও বরফের গভীরে। নগ্ন পাথর নিয়ে গড়ে উঠেছে পাহাড়ের দু’পাশে থাকা উপত্যকা। ওখানটা শৈবাল জাতীয় উদ্ভিদে ছেয়ে গেছে। খাড়া হয়ে উঠে গেছে এই গিরিসঙ্কট।
তার লক্ষ্যের দিকে।
পরনে ওয়ান-পিস গুজ-ডাউন স্যুট। সাদা-কালো রঙের রেখায় ক্যামোফ্লেজ করা। তার মাথা ঢাকা রয়েছে সোমশ হুডি দিয়ে, স্লে-গগলস পরার কারণে আড়াল হয়ে গেছে চোখ দুটো। একটা প্যাক নিয়ে উঠছে সে। ওটার ওজন একুশ কেজি। ওর মধ্যে বিভিন্ন রকম জিনিস আছে। যেমন : বরফ আকড়ে ধরার কুঠার, সেই কুঠারের এক মাথায় আবার প্যাচানো রয়েছে পলি বোপ (দড়ি)। এছাড়াও আছে হেকলার অ্যান্ড কচ অ্যাসল্ট রাইফেল, অতিরিক্ত বিশ রাউন্ড ম্যাগাজিন এবং একটা ব্যাগে রয়েছে নয়টি অগ্নি-সংযোগকারী গ্রেনেড।
বাড়তি কোনো অক্সিজেন প্রয়োজন নেই তার। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত উঁচুতে উঠেও নয়। বিগত চুয়াল্লিশ বছর ধরে এই পাহাড়কে সে নিজের ঘর-বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। যেকোনো শেরপার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো জ্ঞান রাখে। তবে এই ব্যক্তি কিন্তু শেরপাদের ভাষায় কথা বলে না। এর চোখ দুটোও ভিন্ন রঙের। একটা হিম শীতল নীল অন্যটা ধবধবে সাদা! এরকম ভিন্ন ধরনের দুটো চোখ থাকার কারণে তাকে সহজেই আলাদা করে লক্ষ করা যায়। আরেকটা বিষয় তাকে আলাদা করার জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। সেটা হলো, তার ঘাড়ে থাকা ট্যাটু।
কানে থাকা রেডিও বেজে উঠল।
‘মঠে পৌঁছেছ?”
নিজের গলা ছুঁয়ে নিল সে। ‘চোদ্দ মিনিট লাগবে।’
‘দুর্ঘটনা সম্পর্কে কিছু একটা শব্দও ফাঁস হওয়া চলবে না।’
‘সব সামাল দেয়া হবে।’ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়ার মধ্যেও নিজের কণ্ঠস্বর অক্ষত রাখল সে। নির্দেশদাতার কণ্ঠে ভয়ের সুর ছিল, বিষয়টা তার কান এড়ায়নি। কত ভয় পায়। আসলে এই গ্রানাইট ক্যাসলের এদিকে ও খুব একটা আসে না। তাই নির্দেশদাতা ভয় পাচ্ছেন। একদম কোনো এক প্রান্তে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে।
কেউ তার কাছে এসে কিছু জানতে চায় না। না চাওয়াটাই ভাল।
তবে যখন প্রয়োজন পড়ে তখন ওকে ডেকে নেয়া হয়।
ওর ইয়ারপিস আবার জ্যান্ত হয়ে উঠল। ওরা খুব শীঘ্রি মঠে পৌঁছে যাবে।
জবাব দেয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করল না ও। দূর থেকে ভেসে আসা হেলিকপ্টার রোটরের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে। মগজকে হিসেবের কাজে লাগিয়ে দিল ও। তাড়াহুড়োর কোনো প্রয়োজন নেই। পাহাড় ওকে ধৈর্য ধরতে শিখিয়েছে।
ফুসফুসের গতিকে অক্ষুণ্ণ রেখে লাল-টাইলের ছাদযুক্ত পাথুরে ভবনের দিকে এগিয়ে চলল সে। টেম্প অচ মঠের অবস্থান উপত্যকার কিনারায়। নিচ থেকে এখানে সহজে উঠে আসার রাস্তা একটাই। মঠের সন্ন্যাসী ও তাদের শিষ্যরা বাইরের দুনিয়া নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না।
তবে সেটা বজায় ছিল তিন দিন আগ পর্যন্ত।
ওই দুর্ঘটনা।
তার কাজ ছিল পুরো কাজ একদম পরিষ্কারভাবে শেষ করা।
হেলিকপ্টারের আওয়াজ বেড়ে যাচ্ছে। নিচ থেকে উঠে আসছে ওটা। আপন গতিতে এগোল সে। হাতে যথেষ্ট সময় আছে। হেলিকপ্টারে যারা আছে ওদের মঠে পৌঁছুনো প্রয়োজন।
সবকটা একসাথে খুন করতে সুবিধে হবে।
.
সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট।
হেলিকপ্টার থেকে নিচের পৃথিবীকে দেখে মনে হচ্ছে এটা যেন পুরোদস্তুর একটা ছবির ফটোগ্রাফিক নেগেটিভ। রঙহীন, সাদা-কালো। তুষার ও পাথরে মাখামাখি। কুয়াশা ঢেকে রেখেছে পর্বতের চূড়োগুলোকে, ছায়ায় ঢাকা পড়েছে গিরিসঙ্কটগুলো। বরফ আচ্ছাদিত উপত্যকা থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে সূর্যরশ্মি। প্রতিফলিত রশ্মির দাপটে চোখ প্রায় তুষার অন্ধতায় আক্রান্ত হওয়ার দশা।