দু’জন সামনে এগোতে এগোতে শেরপাদের সাথে নেপালী ভাষায় দ্রুত কী যেন বলল। বিভিন্ন রকম অঙ্গ-ভঙ্গি শেষে নির্দেশ করল এক হাত দিয়ে।
হাতটা লিসার দিকে তাক করা।
সন্ন্যাসী লিসার দিকে পা বাড়ালেন। পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স তার, গায়ের রং ফর্সা কিন্তু ফাঁকাসে, চোখ বাদামি।
সৈনিকের ত্বক অবশ্য একটু কালো। তার দুচোখের অবস্থান স্বাভাবিকের চেয়ে কাছাকাছি। লিসার বুকের ওপর দৃষ্টি আটকে রয়েছে ওর। জ্যাকেটের চেইন খুলে রেখেছে লিসা। লোমশ ওভারকোটের নিচে থাকা স্পোর্টস ব্রা দেখা যাচ্ছে। নেপালিজ সৈনিকের দৃষ্টি ঠিক ওখানেই আটকে রয়েছে।
অন্যদিকে সন্ন্যাসী তাঁর চোখ সংযত রেখেছেন, লিসাকে উদ্দেশ্য করে একটু মাথা নোয়ালেন তিনি। ব্রিটিশ উচ্চারণে নিখুঁত ইংলিশে বললেন, ‘ডা. কামিংস, এভাবে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু বিষয়টা জরুরি। এইচ,আর,এ থেকে জানতে পারলাম, আপনি একজন মেডিক্যাল ডাক্তার।
ভ্রু কুঁচকে মুখ হাঁড়ি করে লিসা জবাব দিল, “হ্যাঁ।
‘কাছের এক মঠে রহস্যময় রোগ দেখা দিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে ওখানে থাকা সবাই। পাশের গ্রাম থেকে এক লোক তিন দিন পায়ে হেঁটে খুন্ডি হাসপাতালে গিয়ে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম খবরটা জানার পর এইচ.আর.এ থেকে কোনো একজন ডাক্তার ওখানে হাজির হবে। পরে জানতে পারলাম ক্লিনিকেই ডাক্তার সংকট চলছে। ডা, সোরেনসন আপনার কথা বললেন, বেজ ক্যাম্পে আছেন আপনি’।
সাইজে ছোট-খাটো কানাডিয়ান ডাক্তারের কথা মনে পড়ল ওর। মহিলা ডাক্তার। এক সন্ধ্যায় লিসা ও সেই ডাক্তার একসাথে চা খেয়েছিল। আমি কীভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি? লিসা প্রশ্ন করল।
‘আমাদের সাথে ওখানে যাবেন? মঠটা দুর্গম জায়গায় হলেও এই হেলিকপ্টারে করে যাওয়া যাবে’।
‘কতক্ষণ…?’ প্রশ্ন করে জশের দিকে তাকাল ও। দলের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে এদিকে এগিয়ে আসছে সে।
সন্ন্যাসী মাথা নাড়লেন। কিছুটা লজ্জা ও কুষ্ঠাবোধ তার চোখে দেখা গেল। যেতে ঘণ্টা তিনেক লাগবে। ওখানে গিয়ে কী অবস্থা দেখতে পাব সেটা আগেভাগে বলা যাচ্ছে না।’ দুশ্চিন্তায় আবার মাথা নাড়লেন।
‘আমরা এখানে একদিন আছি, সমস্যা নেই।’ বলল জশ। বোনের কনুই ধরে কাছে এল ও। কিন্তু আমি তোমার সাথে যাব।’
জশের প্রস্তাব লিসার খুব একটা পছন্দ হলো না। নিজের খেয়াল কীভাবে রাখতে হয় সেটা লিসা ভাল করেই জানে। অন্যদিকে ওকে নেপালের রাজনৈতিক অবস্থাও মাথায় রাখতে হবে। ১৯৯৬ সাল থেকে এখানে বিভিন্ন সময় চোরাগুপ্ত হামলা হয়ে আসছে। মাওবাদীরা মঠগুলোকে ভেঙ্গে সেখানে সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। বিভিন্ন সময় লোকজনদেরকে ধরে কৃষি কাজে ব্যবহৃত কাস্তে দিয়ে একটা একটা করে অঙ্গ কেটে নেয়ার জন্য তারা কুখ্যাত। যদিও এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। কিন্তু নৃশংস ঘটনাগুলো ঘটছে মাঝেমাঝেই।
সৈনিকের হাতে থাকা তেল চিকচিকে রাইফেলের দিকে তাকাল লিসা। সন্ন্যাসীর মতো একজন পবিত্র মানুষের সাথে সশস্ত্র প্রহরী! ছোট ভাইয়ের প্রস্তাবটা হয়তো আরেকবার ভেবে দেখা উচিত।
‘আমার কাছে মনিটরিঙের জন্য কিছু ইকুইপমেন্ট আর সামান্য ফাস্ট এইড কিট ছাড়া তেমন কিছুই নেই’। ইতস্তত করে সন্ন্যাসীকে বলল লিসা। ‘গুরুতর পরিস্থিতি হলে একাধিক রোগীর জন্য আমি হয়তো খুব একটা সাহায্যে আসতে পারব না।’
মাথা নেড়ে হেলিকপ্টার দেখালেন বুদ্ধ। ওটার রোটর এখনো ঘুরছে। ‘ডা. সোরেনসন আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহ করে রেখেছেন। আপনাকে আমরা একদিনের বেশি আটকে রাখব না। আপনি ওখানে গিয়ে কীরকম পরিস্থিতি বুঝলেন সেটা পাইলটের স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে প্রয়োজনমতো জায়গায় জানিয়ে দিতে পারবেন। এমনও হতে পারে পরিস্থিতি এখন অনেকটা অনুকূলে। সেক্ষেত্রে দুপুর নাগাদ আমরা ফিরে আসতে পারব।’
শেষ বাক্যটা বলার সময় তার মুখের ওপর দিয়ে কেমন যেন এক ছায়া দেখা গেল। শেষ কথাটা তিনি নিজে বিশ্বাস করেন না। তার শব্দগুলোতে চিন্তার রেশ ছিল… সাথে ভয়ও।
বুক ভরে পাতলা বাতাস টেনে নিল লিসা। ওতে ওর ফুসফুস কোনমতে ভরল। একটা শপথ করেছিল লিসা। অনেক ছবি তোলা হয়েছে। আসল কাজে নেমে পড়তে হবে ওকে।
বুদ্ধ সন্ন্যাসী লিসার চেহারা দেখে কিছু একটা বুঝতে পারলেন। তাহলে আপনি আসছেন?
‘হ্যাঁ।
‘লিসা…’ সতর্ক করল জশ।
‘আমি ভাল থাকব। ভাইয়ের হাত চেপে ধরল ও। পাহাড়ে ওঠার জন্য তোমাকে একটা টিমের নেতৃত্ব দিতে হবে।’
বোস্টন ববের দিকে ফিরে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জশ।
‘অতএব আমি না আসা পর্যন্ত এখানে নিজের দায়িত্ব পালন করো।’
বোনের দিকে তাকাল জশ। সস্তুষ্ট হতে পারলেও আর কথা বাড়াল না ও। নিজের চোখ-মুখ শক্ত করে বলল, “সাবধানে থেকো।’
রয়্যাল নেপালিজ আর্মি আমার নিরাপত্তা দেবে, সমস্যা নেই।
সৈনিকের অস্ত্রের দিকে তাকাল জশ। ‘সেজন্যই তো চিন্তা হচ্ছে।’ কথাটা যতটুকু সম্ভব হালকা করে বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ও। কিন্তু তিক্ততা প্রকাশ হয়েই গেল।
লিসা জানে এরচেয়ে ভাল কোনো উপায়ে জশকে পটানো যেতো না। চট করে ভাইকে জড়িয়ে ধরল ও। নিজের তাবু থেকে যাবতীয় মেডিক্যাল ব্যাকপ্যাক আনলো। তারপর ঘুরন্ত রোটরের ঝাপটা বাঁচিয়ে চড়ে বসল হেলিকপ্টারের ব্যাকসিটে।