বন্ড হোটেল থেকে বেরোল। মিষ্টি বাতাসে যেন ব্যালের মিউজিক। দিনের বেলা সূর্যের উজ্জ্বল আলো।
রয়্যাল-লেজের প্রথমে ছিল রয়্যাল–জেলেদের গ্রাম। আর লেজো মানে জল। সেকথাটা পরে যুক্ত হয়েছে। এই গ্রামের পিছনে পাহাড়ের জলে হঠাৎ সালফার পাওয়া গিয়েছিল। ফলে লিভারের রোগীদের পক্ষে ভালো–এবং ফ্রান্সে বহুলোক লিভারের রোগে ভোগে। সুতরাং জায়গাটা স্বাস্থ্যকর স্থান বলে পরিচিত হয়ে গেল। কিন্তু জল-বিক্রির ব্যবসা অন্যান্য কোম্পানিব তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বন্ধ হয়ে গেল। তবে মাছ-ধরা ব্যবসাটা অটুট রইল। তাই মোটামুটিভাবে ট্যুরিস্টের ভিড় রইল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নতুন সাজে সাজল রয়্যাল ক্যাসিনো বিল্ডিংটা। সাদা-সোনালি রং, ভেতরে বৃহৎ ঝাড়লণ্ঠন সাজানো বাগান। ফোয়ারাগুলোতে আলোর বাহার। ব্যবসা জমানোর জন্য প্রথমে আনা হল মহম্মদ আলি সিন্ডিকেটকে। জুয়া থেকে সান-বাথ সবই আধুনিক! ভালোই কাস্টমার জুটল।
বন্ড এই ইতিহাস-চিন্তা মন থেকে দূর করল।
ল্য শিফের ভিলাটা একবার দেখা ভালো!
বন্ডের গাড়িটা নতুন মডেল। হাইস্পিডে ড্রাইভ করল বন্ড।
কয়েক ঘন্টা পরেই হার্মিটেজ বার। একটা বড়ো জানলার পাশের টেবিলটায় বসল সে। ঐশ্বর্যমণ্ডিত গৃহসজ্জা। মেহগনি, চামড়া আর পেতলের নানা আসবাব, নানা কাজ। পানীয়ের অর্ডার দিয়ে লক্ষ করল, ছেলেরা খাচ্ছে শ্যাম্পেন, মেয়েরা মার্টিনি।
ওই তো ম্যাথুস। তার পাশে একটি মেয়ে। বন্ড ইচ্ছে করে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
আবে, মঁসিয়ে বন্ড! আপনি এখানে, একা! কারুর জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি?…আসুন, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি হচ্ছেন মাদমোয়াজেল লিন্ড। আমার সহকর্মী। আর ইনি মি বন্ড, জ্যামাইকার বড়ো ব্যবসায়ী।
বন্ড বলল–আসুন, আমি একাই রয়েছি।
পানীয়ের অর্ডার দেওয়া হল ওদের জন্য। মেয়েটি বেশ স্মার্ট, কিন্তু বেশি কথা বলছে না। নীল চোখ, চুলে বব-ছাঁট। চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা ভাব, যেন সব কিছুকে ঠাট্টা করছে। মেয়েটির গলায় সোনার চেন, আঙুলে পোখরাজের আংটি। ঠোঁটে লিপস্টিক। নেলপালিশে রাঙানো নখ। সুন্দর শরীর গঠন। ধূসর রঙেব স্কার্ট ব্লাউজ। কোমরে বেল্ট, স্ট্র হ্যাট পাশের চেয়ারে রেখেছে।
মেয়েটার চেহারা আকর্ষণীয়, কিন্তু ওপর-ওপর একটা শান্ত ভাব। তাই বন্ডের কৌতূহল বাড়ছিল। এর সঙ্গেই কাজ করতে হবে। সেটা ভেবে মনে একটা অস্বস্তি মেশানো আনন্দ হচ্ছে।
হঠাৎ ম্যাথুস উঠে পড়ল।
–দাঁড়াও আমি ডিনারের ব্যবস্থাটা পাকা করে ফেলি। কিন্তু লিন্ড, সন্ধেটা আমি তোমার সঙ্গে থাকছি না।
মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
বন্ড বলল— আপনি আজ যদি একা আমার সঙ্গে ডিনারে যোগ দেন তো–
–আপত্তি নেই। তারপর কি আমবা ক্যাসিনোতে যাব? মঁসিয়ে ম্যাথুস বলছিলেন, আপনি প্রায়ই
–যদি আপনার অসুবিধে না হয়–
–না, না, অসুবিধে কীসের। হয় তো আমি যাওয়াতে আপনার সৌভাগ্য বেড়ে যেতে পারে।
মেয়েটাকে কিছুটা বুঝল বন্ড। কাজের ব্যাপারে সিরিয়াস। কাজের পর গল্প-গুজব করা যায়, বন্ধুত্ব হতে পারে।
ম্যাথুস ফিরে এল। বন্ড একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের ছুতো করে উঠে পড়ল। হ্যান্ডশেক করল মেয়েটির সাথে। সেই হাতের স্পর্শে বুঝিয়ে দিল, জরুরি কথা আছে। বন্ডের চলে যাবার ভঙ্গিটা লক্ষ করল মেয়েটি।
ম্যাথুস বলল–ও আমার বন্ধু।
মেয়েটি বলল–হা। চেহারাটা খুব ভালো। কিন্তু কোথায় যেন একটা নিষ্ঠুরতার ভাব আছে।
হঠাৎ, ঝনঝন, … ঝনঝন…
জানলার কাচ গুঁড়ো করে কী যেন এসে পড়ল ঘরে। অতি আকস্মিক আঘাত। টেবিল, র্যাক, বোতল— সব চুরমার! চারদিকে আর্তনাদ, চিৎকার, আতঙ্ক, হল্লা।
জানলা দিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার আগে ম্যাথুস লিন্ডকে বলল তুমি এখানেই বসে থাকো, কোথাও যেও না।…
০৬. ফুটপাত ধবে হাঁটছিল বন্ড
তার কিছু আগে বাইরে ফুটপাত ধবে হাঁটছিল বন্ড। দুপাশে গাছের সারি। সূর্যের তাপ, তাই গাছের ছায়া ভালো লাগছিল।
গাছতলায় দাঁড়ানো লোক দুটোর ভাব দেখলেই সন্দেহ জাগে! ওরা হোটেল স্প্লেনডিড এর মেইন গেট থেকে একশো গজ দূরে, ফিসফিস করে কথা বলছে। পরনে স্যুট, স্ট্র-হ্যাটে কালো ফিতে। দুজনের করে ক্যামেরা বক্স ঝুলছে–লাল, নীল।
বন্ড যখন ওদের থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে, তখন লাল ক্যামেরার কেস যার কাঁধে, সে নীলকে কী যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। চারদিকে কম্পন। বন্ড নিজেও ছিটকে পড়ল একটা গাছের তলায়। চিৎ হয়ে পড়ে শুনতে পেল মাটিতে গুমগুম ধ্বনি। আধাঅজ্ঞান অবস্থায় সে টের পেল শূন্যে উড়ছে, গাছের ডাল, চুন-সুরকি, পাথরের টুকরো এবং মানুষের খণ্ড-বিচ্ছিন্ন দেহ। বারুদের গন্ধ, পোড়া কাঠ, পোড়া মাংসের গন্ধ। রাস্তায় গর্ত, দুটো গাছ উপড়ে পড়েছে।
লোকদুটোর পাত্তা নেই। তবে লালরঙের কী একটা রাস্তায় পড়ে আছে।
বন্ড বমি করতে শুরু করল।
সামলে নিয়ে কোনো মতে গাছটা ধরে উঠে দাঁড়াল। এই গাছটাই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
সামনে ম্যাথুস।
হোটেলের রুমে ঢুকে শুনল ঢং ঢং দমকলের গাড়ির শব্দ। পুলিশ ও অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িও এসে গেছে।
বঙ রক্তমাখা পোশাক ছাড়ছে। ম্যাথুসের প্রশ্নের উত্তরে সে লোক দুটির চেহারার বর্ণনা দিহিতা।
হঠাৎ টেলিফোনে ম্যাথুস বলল–শোনো, পুলিশকে বলো, যে ইংরেজ ভদ্রলোক, জ্যামাইকা থেকে এসেছে, তাকে নিয়ে বেশি না ভাবলেও চলবে। ওরা বলবে— দুই বুলগেরিয়ানের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব! প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপার। আমি পরে বুঝিয়ে বলব। একজন অন্যজনকে বোমা মেরেছে। তৃতীয় জন এখন ঘুরঘুর করছে। যাই হোক, অপরাধী পালাতে চাইছে। ওকে ধরতে হবে।…. হ্যাঁ, অপরাধী প্যারিসে যাবার চেষ্টা করবে, খেয়াল রেখো।