বন্ড বুঝল, লোকটা পেশাদার খুনি। দুটি লোকই খুব ওস্তাদ। আপশোশ হল যে, সে বুঝতে পারেনি–যখন খুশি মনে সে শ্যাম্পেন খাচ্ছিল, তখন শত্রুপক্ষ ওদের যথেষ্ট বেগ দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ভেসপার বোকা কিন্তু বন্ড নিজেও কম বোকামি করেনি।
যাকগে, এখন আর ভেবে কী হবে। ল্য শিফের গাড়ি এখন সত্তর মাইল স্পিডে চলছে। বন্ড ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। জানলা দিয়ে দেখছে, ভোর হয়ে এল। এখন গাড়ি বোধহয় যাচ্ছে ল্য শিফের ভিলার দিকে, অর্থাৎ ভিলার মোড়টা আর এক দুমাইল দূরে। বোঝা গেল, ভেসপারকে এখন টোপ বানিয়ে এগোবে ওরা।
ল্য শিফের ভিলায় পৌঁছে গেছে ওর গাড়ি। ভিলার দশা এখন জীর্ণ কোনো স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য নেই। অবশ্য ল্য শিফের কায়দা-কানুনের পক্ষে এমন বাড়িই উপযুক্ত। গুতো মারতে মারতে বন্ডকে নামানো হল গাড়ি থেকে। বন্ড বুঝল, এইবার তা ভেসপারের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হবে। ভাবতেই সাহসী বন্ডের বুকে কম্পন শুরু হল।
কর্সিকান লোকটি অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে ভেসপারকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল। বন্ড শান্ত মনে রোগা লোকটার পাশে পাশে চলল। ডানদিকের দরজার সামনে ল্য শিফ দাঁড়িয়ে আছে। ভেসপারকে ভিতরের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেকজন। এই মুহূর্তে নিজেকে প্রস্তুত করল বন্ড।
মুহূর্তের মধ্যে বন্ডের প্রচণ্ড লাথি লোকটার হাঁটুর নীচে আঘাত করল। লোকটা চিৎকার করে ছিটকে পড়ল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই বন্ড ছুটল ভেসপারের দিকে। তার এখন এই পা দুটোই শুধু সম্বল। কিন্তু কর্সিকানের উদ্দেশে মারা লাথিট লক্ষ্যভ্রষ্ট। বরং লোকটাই বন্ডের পা-টা ঘুরিয়ে দিতেই মেঝের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল বন্ড। এইবার রোগা লোকটা এগিয়ে এল। কলার ধরে টেনে তুলল বন্ডকে। পিস্তলটা দিয়ে বন্ডের পায়ে সজোরে আঘাত করল। আর্তনাদ করে কুঁকড়ে গেল বন্ড। লোকটা বলল–ফের এমন করলে সবকটা দাঁত ভেঙে দেব।
মুহ্যমান বন্ড দেখতে পেল, ল্য শিফ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। ভেসপার নেই। ল্য শিফের মুখে ব্যঙ্গ হাসি। বলল–ওয়েলকাম ফ্রেন্ড। সময় নষ্ট করে লাভ কী?
সত্যিই লাভ নেই। বন্ড এবার ওদের কবজায়।
১৭. এই ঘরটা বিরাট
এই ঘরটা বিরাট। ড্রয়িংরুম না ডাইনিং রুম কে জানে। সারা দেয়াল জুড়ে আয়না। রং ওঠা সোফা ঘরের মাঝখানে কোনো টেবিল নেই। শুধু একটা চৌকো কার্পেট। জানলার কাছে অদ্ভুত শেফের একটি চেয়ার। ভেলভেটের গদি। নীচু টেবিলে জলের বোতল আর দুটো গ্লাস। আর একটা গদিহীন বেতের চেয়ার আছে।
ল্য শিফ বলল–ওকে রেডি করে নিয়ে এস। গণ্ডগোল করলে উচিতমতো কিছুটা জখম করে দেবে।
এবার বন্ডের দিকে তাকিয়ে সে নিস্পৃহভাবে বলল–জামাকাপড় ছেড়ে ফেল। নইলে বেসিল একটা একটা করে তোমার আঙুল ভেঙে দেবে। তোমার শরীর নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। তবে তোমার মরণ বাঁচন নির্ভর করছে তোমার কথাবার্তার ওপর।
ল্য শিফের ইঙ্গিতে বন্ডের হাতের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। ছুরি দিয়ে বন্ডের কোটের পিছনদিকটা চিরে দিতেই হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। ডিনার জ্যাকেটও দুটুকরো। এটা একধরনের পুলিশি কায়দা। লোকটা বলল—কুইক।
গায়ের শার্টটা খুলে ফেলল বন্ড। ল্য শিফ বড়ো চেয়ারটায় সিংহাসনের মতো বসে ইশারা করল। কফি এল। আয়েস করে গেলাসে কফি ঢেলে নগ্ন এন্ডের দণ্ডায়মান শরীরটাকে ভালো করে লক্ষ করল মে। হ্যাঁ, আঘাতগুলো গায়ে চাপ চাপ দাগের সৃষ্টি করেছে। বন্ডের মুখে ক্লান্তি এবং আতঙ্ক।
–সিট ডাউন। বলে বেতের চেয়ারটা দেখিয়ে দিল ল্য শিফ। বন্ডের দুহাত চেয়ারের দুই হাতলের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা হল। বুকের ওপর দিয়েও একটা দড়ি চেয়ারের পিঠের সঙ্গে গিট দিয়ে বাঁধা হল। চেয়ারের পায়া দুটোর সঙ্গে দুই হাঁটু শক্ত করে বাঁধতে ভুল হল না।
এরপর স্নেহভরে বন্ডকে দেখতে দেখতে হাত উঠিয়ে এমন একটা টেকনিক্যাল অত্যাচারের চমক দিল ল্য শিফ, যে মুহূর্তের মধ্যে বন্ডের ঘাড় পিছনে হেলে পড়ল। সারা দেহ যেন রক্তশূন্য, যেন প্রচণ্ড ঘাম ঝরছে।
আর্তনাদ করল বন্ড।
ল্য শিফ বলল–আরো অনেক কায়দা আছে, বুঝেছ বন্ধু। সেগুলো ধীরে ধীবে প্রকাশ পাবে… যাই হোক, কাজের কথা শুরু করি। নিশ্চয়ই এও বুঝেছ, তোমার খেল খতম। আমাদের কাছে তুমি নেহাতই শিশু। তোমার কর্তারা তোমাকে পাঠিয়ে ভুল করেছে…. এবার বল, টাকাটা কোথায়?
এবার গর্জন করল ল্য শিফ। সঙ্গে সঙ্গে বেতের ঘা মেরে সেই টেকনিক্যাল যন্ত্রণা দান। বন্ড কাঁপতে থাকল।
ল্য শিফ বলল–শোন খোকা, আমার কথাবার্তাগুলোকে রূপকথার গল্প ভেব না। আমার অভিধানে দয়া-মায়া বলে কোনো শব্দ নেই। তাছাড়া গল্পে যা থাকে, বাস্তবে তা হয় না–ভিলেনের নিপাত, নায়কের পুরস্কার, নায়ক-নায়িকার মিলন–এসব হয় না। কথা যদি না শোন, তাহলে তোমার সামনে মেয়েটিকে এনে এমন অত্যাচার করা হবে, তা দেখলে তুমিও পাগল হয়ে যাবে। তবুও যদি গোঁয়ার্তুমি করো, তাহলে দুজনকেই বীভৎসভাবে আমরা খুন করতে বাধ্য। তোমার মৃতদেহ এখানেই পড়ে থাকবে। কবর দেবার লোকজনও পাওয়া যাবে না। আর আমি? হাঃ হাঃ–আমি চলে যাব বিদেশে। সেখানে চমৎকার একটি বাড়িতে বিয়ে করে সংসার পাতব। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে আনন্দে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি টাকা দিলে ভালো কথা,
দিলেও আমার কিছু আসে যায় না।
আবার সেই অত্যাচার। এখন পর্যন্ত বন্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যতটা পারা যায় অত্যাচার সহ্য করতে হবে।