সুতরাং, যেমন কোট এবং ছিটকে মূল্য হিসেবে দেখতে গিয়ে আমরা তাদের ব্যবহার-মূল্য থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, ঐ মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার বেলাও ঠিক তাই করি : আমরা তাদের ব্যবহার্য রূপগুলির তথা বোনার কাজের ও সেলাইয়ের কাজের পার্থক্যটা ধরি না। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যদ্বয় যেমন কাপড় এবং সুতোর সাহায্যে সম্পাদিত বিশিষ্ট বিশিষ্ট উৎপাদনশীল কর্মের সংযোজন, অথচ অপরদিকে যেমন মূল্য হিসেবে কোট এবং ছিট পার্থক্যবিমুক্ত সমজাতীয় শ্রমের ঘনীভূত রূপ, সেইরকম এই মূল্যদ্বয়ের মধ্যে যে শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করে ররেছে তাদেরও কোট এবং ছিটের সঙ্গে উৎপাদনী সম্বন্ধ বলে ধরা হবে না, ধরা হবে কেবল মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসেবে। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যের সৃষ্টিতে বোনার কাজ এবং সেলাইয়ের কাজ হল আবশ্যিক উপাদান, যেহেতু এই দুই রকমের শ্রম হ’ল ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিশিষ্ট; সেহেতু সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ ঐ দ্রব্যগুলির মূল্যের মর্মবস্তু হতে পারে শুধুমাত্র এই হিসেবে যে তাদের বিশেষ বিশেষ গুণগুলি ছাটাই করে ফেলা যায়; তাদের এই একটি সমগুণ আছে যে উভয়েই মানুষের শ্ৰম।
অবশ্য, কোট এবং ছিট কেবলমাত্র মূল্য নয়, পরন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য, এবং আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে কোট হচ্ছে ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ মূল্যবান। তাদের মূল্যের ভিতর এই পার্থক্য কোথেকে এল? এর কারণ হল এই যে, কোটের মধ্যে শ্ৰম বিধৃত আছে তার অর্ধেক আছে ১০ গজ ছিটের মধ্যে, এবং তারা মাঝে ১০ গজ ছিটের উৎপাদনে যতটা ব্যবহাৰ্য শ্রমশক্তি লেগেছে তার দ্বিগুণ লেগেছে কোটের উৎপাদনে।
সুতরাং ব্যবহার-মূল্যের ক্ষেত্রে, একটি পণ্যের মধ্যে বিধুতি শ্রমকে ধরা হয় গুণগত শ্ৰম হিসেবে, আর মূল্যের ক্ষেত্রে। তাকে ধরা হয় পরিমাণগত শ্ৰম হিসেবে, এবং তাকে পরিণত ক’রে নিতে হয় মানুষের সরল শ্ৰমে। প্ৰথম ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হ’ল কেমন করে এবং কিভাবে, অপর ক্ষেত্রে কতটা? কত সময়? যেহেতু একটি পণ্যের মধ্যে বিধূত মূল্যের পরিমাণ বলতে বোঝায়। তার মধ্যে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে শুধু তাই, সেহেতু তা থেকে দাড়ালো এই যে একটি বিশেষ অনুপাত ধরে নিলে, মূল্যের দিক থেকে সমস্ত পণ্য সমান হতে বাধ্য।
একটি কোট উৎপন্ন করতে যত ব্লকমের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার্য শ্ৰম লাগে তাদের সবারই উৎপাদিকা শক্তি যদি অপরিবর্তনীয় থাকে, তবে কোটের উৎপাদন-সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই বেশি হবে তাদের মোট মূল্য। যদি একটি কোট বলতে বোঝায় ‘ক’ দিনের শ্রম, দুটি কোট বলতে বোঝাবে ২ক দিনের শ্রম, ইত্যাদি। কিন্তু ধরা যাক কোটের উৎপাদনে উপযোগী সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ অথবা অর্ধেক হয়ে গেল। প্রথম ক্ষেত্রে একটি কোটি আগেকার দুটি কোটের সমান মূল্যবান; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, দুটি কোটের মূল্য হবে। আগেকার মাত্র একটি কোটের সমান, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই একটি কোটি আগেকার মতোই সমান কাজ দেয়, এবং তার মধ্যে বিধৃত শ্ৰম গুণের দিক থেকে একই আছে। কিন্তু তার উৎপাদনে যে শ্ৰম লেগেছে, তার পরিমাণ গেছে বদলে।
ব্যবহার মূল্যের বৃদ্ধির মানে হচ্ছে বৈষয়িক ধন-সম্পদের বৃদ্ধি। দুটো কোট দু’জন মানুষ পরতে পারে, একটি কোট পরতে পারে একজন মানুষ। যাই হোক না কেন, বৈষয়িক সম্পদের বৃদ্ধি এবং মূল্যের পরিমাণ হ্রাস একই সঙ্গে ঘটতে পারে। এই বিপরীতমুখী গতির মূলে রয়েছে শ্রমের দ্বৈত চরিত্র। উৎপাদিকা শক্তি বলতে অবশ্যই বুঝতে হবে কেবলমাত্র কোন একটা ব্যবহারযোগ্য মূর্ত শ্রম; একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পাদিত যে কোন উৎপাদনশীল কর্মের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার উৎপাদিক শক্তির উপর। কাজেই ব্যবহাৰ্য শ্ৰম, উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে, দ্রব্যের কম। বা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের উৎস। অপরদিকে, উৎপাদন ক্ষমতার কোন পরিবর্তনেই মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার কোন তারতম্য হয় না। যেহেতু উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে শ্রমের ব্যবহার্যতার মূর্ত রূপের একটি গুণ, সেহেতু যে মুহূর্তে। শ্রমকে তার উপযোগপূর্ণ ঘূর্তিরূপ থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই সেই মুহুর্তে অবশ্যই তার ‘ উৎপাদিকা শক্তির আর কোন প্রভাব থাকতে পারে না। তখন উৎপাদিকা শক্তির। হ্রাস-বৃদ্ধি যতই হোক না কেন, একই শ্রম একই সময় ধর্ক্সে চালালে, একই আয়তনের মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু তা সমান সমান সময়ে ব্যবহারগত মূল্য তৈরি করবে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনে; উৎপাদিকা শক্তি যদি বাড়ে, তবে বেশি পরিমাণে; আর যদি কমে তো কম পরিমাণে। উৎপাদিকা শক্তি যো-পরিবর্তন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং তার ফলে সেই শ্রম থেকে উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের পরিমাণও বৃদ্ধি করে, তা এই বর্ধিত ব্যবহার মূল্যের মোট মূল্যকে দেয় কমিয়ে,-যদি এরূপ পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় কমে যায়; আর, বিপরীত ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীতই হবে।
একদিকে সমস্ত শ্ৰমই হ’ল, শারীরবৃত্তের দিক থেকে, মানুষের শ্রমশক্তির ব্যত্ব এবং একইরকম বিশ্লিষ্ট শ্রম হিসেবে তা পণ্য মূল্যের সৃজন ও রূপায়ণ সাধন করে। অপরদিকে, সমস্ত শ্ৰমই হ’ল এক একটি বিশ্লিষ্ট রূপে এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত মানুষের শ্রমশক্তি এবং তার ফলে, ব্যবহার্য শ্রম হিসেবে তা তৈরী করে ব্যবহারমূল্য।(৪)