যা হোক, কোর্টুটি দরজীই পরিধান করুক আর তার খরিদারই পরিধান করুক,। উভয়ক্ষেত্রেই তা ব্যবহারমূল্যের কাজ করে। আর যদি দরজীর কাজ একটি বিশেষ ব্যবসায়ে, সামাজিক শ্রম-বিভাগের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়ে যায়, তাহলেও সেই অবস্থায় কোট এবং কোট তৈরির শ্রম-এই উভয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের কোনই তারতম্য হয় না। জামা-কাপড়ের অভাব যেখানেই তাদের বাধ্য করেছে, সেখানেই তারা হাজার হাজার বছর ধরে জামা-কাপড় তৈরী করে এসেছে, অথচ একটি লোকও তখন দরজী হয় নি। কিন্তু স্বতঃস্ফৰ্তভাবে প্ৰকৃতিসদ্ভুত নয় এমন যে-কোন সম্পদের মতো, কোটের এবং ছিটের অস্তিত্বের উৎস হচ্ছে এমন একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল শ্ৰম, যা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত, যা প্ৰকৃতিদাত্ত বস্তুকে মানুষের অভাব নিরসনের কাজে লাগায়। অতএব যেহেতু শ্রম হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা, অর্থাৎ ব্যবহার্য (উপযোগী) শ্রম, সেহেতু মানবজাতিত্ব অস্তিত্বের জন্য তা হচ্ছে রূপ-নির্বিশেষে সৰ্ববিধ সমাজের, একটি আবশ্যিক শর্ত; এ হচ্ছে প্ৰকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটি চিরন্তন আবশ্যিকশর্ত, যা না হলে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে কোন বাস্তব আদান-প্ৰদান হ’তে পারে না, সুতরাং কোন জীবনও সম্ভব নয়।
কোট্, ছিট প্রভৃতি ব্যবহার মূল্য, অর্থাৎ পণ্যের অবয়ব গঠিত হয়েছে দু’রকম পদার্থের সমন্বয়ে-বস্তুর এবং শ্রমের। এদের উপর যে ব্যবহার্য শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তা যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সর্বদাই পড়ে থাকে এমন কিছু উপাদান, প্ৰকৃতি যা মানুষের সাহায্যে ছাড়াই সরবরাহ করেছে। মানুষ কাজ করতে পারে। কেবল প্রকৃতির মতোই, অর্থাৎ বস্তুর রূপান্তর সাধন ক’রে।(১) শুধু এইটুকুই নয়, এই রূপান্তর সাধনের কাজে সে নিরস্তুর প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য পাচ্ছে। কাজেই, আমরা দেখতে পাই যে, শ্ৰমই বৈষয়িক ধনসম্পদের তথা শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের একমাত্র উৎস নয়। উইলিয়ম পেটি যেমন বলেছেন, শ্রম তার জনক এবং ধরিত্রী তার জননী।
এবার ব্যবহার মূল্যরূপে বিবেচিত পণ্য ছেড়ে পণ্যের মূল্যের প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক। আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে, কোটের মূল্য ছিটের মূল্যের দ্বিগুণ। কিন্তু। এটা হচ্ছে একমাত্র পরিমাণগত প্ৰভেদ, যা আপাততঃ আমরা ধরছি না। আমরা অবশ্য মনে রাখছি যে কোটের মূল্য যদি ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ হয়, তা হলে ২০ গজ ছিটের মূল্য এবং একটা কোটের মূল্য একই। মূল্যের দিক থেকে ঐ কোট এবং ঐ ছিট অনুরূপ জিনিস দিয়েই গড়া মূলতঃ অভিন্ন শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগত প্ৰকাশ। কিন্তু দরজীর কাজ এবং তাঁতের কাজ গুণগতভাবেই ভিন্ন রকমের শ্ৰম। অবশ্য, এরকম অবস্থারও সমাজ আছে, যেখানে একই লোক কখনো দরজীর কাজ কখনো বা তাঁতের কাজ করে, সে ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের শ্রম একই ব্যক্তির শ্রমের রকমফের মাত্র। তা ভিন্ন ভিন্ন লোকের বিশেষ বিশেষ এবং নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট কাজ নয়; যেমন আমাদের দরজী যদি একদিন কোট তৈরী করে এবং আর একদিন পায়জামা তৈরী করে তা হলে তা দ্বারা বুঝায় একই লোকের শ্রমের অদলবদল। অধিকন্তু, আমরা এক নজরে দেখতে পাই যে, আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজে, মনুষ্যশ্রমের যে-কোন একটি অংশ, চাহিদার হেরফের অনুসারে, কখনো দরজীর কাজে, কখনো বা তাঁতের কাজে প্ৰযুক্ত হয়। এই পরিবর্তন হয়তো নিবিরোধে না ঘটতে পারে কিন্তু ঘটবে নিশ্চয়ই।
উৎপাদনশীল কাজকর্মের বিশেষ রূপটি, অর্থাৎ শ্রমের ব্যবহার্যতার চরিত্রটি বাদ দিলে, শ্রম মানে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় ছাড়া আর কিছু হয় না। যদিও দরজীর কাজ আর তাঁতের কাজ গুণগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীল কাজ, তাহলেও এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের মস্তিস্ক, স্নায়ু ও পেশীর উৎপাদনশীল ব্যয়, এবং এই হিসেবে ওগুলো মানুষের শ্রম অর্থাৎ মানুষের শ্রমশক্তি প্রয়োগ করার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। অবশ্য এই যে শ্রমশক্তি ভিন্ন ভিন্ন কাজে প্রয়োগ সত্ত্বেও ষা একই থেকে যায়, তার এই নানান ধরনে প্ৰয়োগ সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই একটা মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হবার পরেই। কিন্তু পণ্যের মূল্য বলতে বোঝায় মানুষের বিশ্লিষ্ট শ্রমে, নির্বিশেষে মানবিক শ্রমের ব্যয়। যেমন সমাজে কোন একজন সেনাপতির বা কোন একজন ব্যাংক মালিকের মস্ত।বড় ভূমিকা আছে কিন্তু অপরদিকে, নিছক মানুষের ভূমিকা অতি নগণ্য;(২) মানুষের শ্রমের বেলায়ও সেকথা খাটে। এ হচ্ছে সৰ্বল শ্রমশক্তির ব্যয়, অর্থাৎ, যে শ্রমশক্তি কোন বিশ্লিষ্ট রূপে বিকশিত হওয়া ছাড়াও গড়ে প্ৰত্যেকটি সাধারণ ব্যক্তির জৈবদেহের মধ্যেই বর্তমান। একথা সত্য যে, সরল গড় শ্রম বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে; কিন্তু একটি বিশেষ সমাজে তা নির্দিষ্ট। দক্ষ শ্রমকে হিসেব করা হয় কেবল ঘনীভূত সরল শ্রম বলে অথবা, বলা যায়, কয়েকগুণ সরল শ্রম বলে; কোন একটু নির্দিষ্ট পরিমাণ দক্ষ শ্রমকে ধরতে হবে অধিকতর পরিমাণ সরল শ্রম হিসেবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে এই রকমে এক শ্রমিকে অন্য শ্রমে পরিণত করার কাজ অনবরতই চলছে। কোন একটি পণ্য দক্ষতম শ্রমের ফল হতে পারে, কিন্তু তার মূল্য বলতে বুঝতে হবে তাকে সমীকরণ দ্বারা সরল অদক্ষ শ্ৰমে পরিণত করে নিলে যা দাঁড়ায় কেবল তারই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ।(৩) বিভিন্ন রকমের শ্রমকে সরল শ্রমের মানদণ্ডে পরিণত করতে হলে তার অনুপাত কি হবে তা নির্ধারিত হয় একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এই ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রক্রিয়াটি উৎপাদনকারীদের অগোচরে ঘটে, এবং তার ফলে তাকে সামাজিক প্রথা দ্বারা নির্ধারিত বলে মনে হয়। সহজ করে বলাৰু জন্য আমরা এখন থেকে প্ৰত্যেক রকমের শ্রমকে অদক্ষ সরল শ্রম বলে ধরব, তাতে আর কিছু হবে না, আমরা শুধু তাকে বারংবার রূপান্তরিত করার বন্ধটি থেকে বাঁচবো।