তা হলে ওয়েকফিলডের মত অনুসারে, উপনিবেশগুলিতে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির ফলাফল কি? উৎপাদনকারীদের এবং জাতীয় সম্পদদের ছড়িয়ে দেবার এক বর্বরতা বিস্তারী প্রবণতা।[১৭] নিজ নিজ উদ্যোগে কর্মরত, এমন অগণিত মালিকের মধ্যে উৎপাদনের উপায়সমূহ ভাগাভাগি কেবল মূলধনের কেন্দ্রীভবনকেই ধ্বংস করে দেয়না, সম্মিলিত প্রমের সমস্ত ভিত্তিকেও ধ্বংস করে দেয়। প্রত্যেকটি দীর্ঘকালসাপেক্ষ উদ্যোগ যার জন্য লাগে কয়েক বছর এবং চাই স্থির মূলধনের বিনিয়োগ, এমন সমস্ত উদ্যোগই বাধাপ্রাপ্ত হয়। ইউরোপে মূলধনের বিনিয়োগে ক্ষণিকের দ্বিধাও দেখা দেয় না, কেননা সেখানে শ্রমিক শ্রেণী তার উপাঙ্গ—সব সময়েই বাড়তি এবং সব সময়েই হাতের কাছে মজুদ। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে? ওয়েকফিঙ এক অতি বেদনাময় কাহিনীর বলেন। তিনি কথা বলছিলেন ক্যানাভা এবং নিউ ইয়র্ক অঙ্গ-রাষ্ট্রের কয়েকজন খনিকের সঙ্গে, যেখানে অভিবাসনের ঢেউ মাঝে মাঝে রুদ্ধ হয়ে যায় এবং জমা হয় সংখ্যাতিৰিক্ত শ্রমিকের কিছু তলানি। এই নাটকটির একটি চরিত্র বলেন, “আমাদের মূলধন তৈরি ছিল এমন অনেক কর্মকাণ্ডের জন্য, যেগুলি সম্পূর্ণ করতে লাগে বেশ কিছু সময়, কিন্তু এই সমস্ত কর্মকাণ্ড আমরা এমন শ্রমিকদের দিয়ে আরম্ভ করতে পারি না, যারা, আমরা জানি, শীঘ্রই ছেড়ে চলে যাবে। আমরা যদি এমন অভিবাসীদের গুম করে রাখা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম তা হলে আমরা খুশি মনে তাদের নিযুক্ত করতাম এবং উচু মজুরি দিতাম; এমনকি যদি আমরা এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারতাম যে তারা ছেড়ে চলে যাবে কিন্তু সেই সঙ্গে, সর্বত্র আমাদের প্রয়োজনমত, শ্রমের নোতুন সরবরাহ পাঞ্জা যাবে, তা হলেও তাদের আমরা নিযুক্ত করতাম।[১৮]
আমেরিকান চাষীদের বিক্ষিপ্ত কৃষির সঙ্গে ইংরেজ ধনতান্ত্রিক কৃষি ও তার “সন্মিলিত” শ্রমের প্রতি তুলনা করার পরে, ওয়েকফিল, অসতর্ক মুহূর্তে মেডেলের উলটো পিঠটি আমাদের এক পলকে দেখে নেবার সুযোগ দিয়েছেন। তিনি আমেরিকার জনসাধারণের বিপুল সমষ্টিকে চিত্রিত করেছেন সচ্ছল, স্বাধীন, কর্মঠ এবং অপেক্ষাকৃত কৃষ্টিসম্পন্ন বলে, যেখানে ইংরেজ কৃষিশ্রমিক হল একটা শোচনীয় বেচারা, একটা ভিক্ষাজীবী। উত্তর আমেরিকা এবং কয়েকটি নতুন উপনিবেশে ছাড়া আর কোথায় কৃষিকর্মে নিযুক্ত স্বাধীন শ্রমের মজুরি শ্রমিকের নিছক জীবনধারণের মাত্রা বেশি ছাড়িয়ে যায়? নিঃসন্দেহে, ইংল্যাণ্ডে খামার-ঘোড়াগুলি যেহেতু মূল্যবান সম্পত্তি, সেহেতু ইংরেজ চাষীদের তুলনায় ভাল খোরাক পায়।[১৯] কিন্তু তাতে কি এসে যায়, জাতীয় সম্পদ স্বভাবতই জনগণের দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে অভিন্ন, সেটাই আরেকবার প্রমাণ হয়।
তা হলে উপনিবেশগুলির ধনতন্ত্র-বিরোধী ক্যান্সারকে কি করে নিরাময় করা যায়? মানুষ যদি এক ধাক্কায় সমস্ত সাধারণ জমিকে ব্যক্তিগত জমিতে পরিণত করতে সম্মত হত, তা হলে তারা নিশ্চয়ই এই পাপের মূলকে ধ্বংস করে দিত, কিন্তু সেই সঙ্গে উপনিবেশগুলিকেও। কৌশলটা হল কিভাবে একই সঙ্গে দুটি পাখিকে খতম করা যায়। যোগান ও চাহিদার নিয়মের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে, সরকার এই কুমারী মাটির একটা কৃত্রিম দাম ধার্য করে দিক, এমন একটা দাম যা অভিবাসীকে বাধ্য করে মজুরির বিনিময়ে দীর্ঘকাল ধরে কাজ করতে যার আগে সে জমি কেনার মত এবং নিজেকে একজন স্বাধীন চাষীতে পরিণত করার মত যথেষ্ট টাকা উপার্জন করতে সক্ষম হবে না। [২০] মজুরি-শ্রমিকদের কাছে অপেক্ষাকৃত নিষেধমূলক দামে জমি বিক্রয় থেকে যে-তহবিল তৈরি হবে, যোগান ও চাহিদার পবিত্র নিয়মটি লংঘন করে শ্রমের মজুরি থেকে আদায়ের সাহায্যে যে তহবিল তৈরি হবে, সেই তহবিলটি সরকার ব্যয় করবে ইউরোপ থেকে উপনিবেশগুলিতে সর্বস্বহারাদের আমদানি করতে। এই অবস্থায় tout sera pour be miux dans be meilleur des mondes possibles। এটাই হল প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশ-বিস্তার”-এর মহান গুপ্ত-রহস্য। বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠেন ওয়েকফিঙ, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে “শ্রমের সরবরাহ অবশ্যই হবে নিরন্তর ও নিয়মিত কারণ, প্রথমত, যেহেতু মজুরির জন্য কাজ না করলে কোনো শ্রমিকই জমি সংগ্রহ করতে পারবে না, সেইহেতু সমস্ত অভিবাসী শ্রমিক কিছুকাল মজুরির বিনিময়ে এবং সম্মিলিত ভাবে কাজ করে আরো শ্রমিক নিয়োগের জন্য মূলধন উৎপাদন করবে; দ্বিতীয়ত, যারা মজুরির বিনিময়ে কাজ করা ছেড়ে দিয়ে জমির মালিক হবে তারা প্রত্যেকেই জমি কিনতে গিয়ে উপনিবেশে নোতুন শ্রম আমদানির জন্য একটা তহবিলের সংস্থান করবে।”[২১] রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত জমির দাম অবশ্যই হতে হবে একটা পর্যাপ্ত দাম”, অর্থাৎ হতে হবে এত উচু যাতে করে যত কাল না অন্যরা তাদের স্থান পূরণের জন্য এগিয়ে না আসে, ততকাল শ্রমিকেরা স্বাধীন জমির মালিক না হতে পারে।[২২] এই “জমির জন্য পর্যাপ্ত দাম” নরম ভাষায় ঘুরিয়ে বলা ‘মুক্তিপণ ছাড়া আর কিছু নয়, যা শ্রমিককে তুলে দিতে হয় ধানকের হাতে-জুরি-শ্রমের বাজার থেকে ছুটি নিয়ে জমিতে অবসর গ্রহণের জন্য। প্রথমত, তাকে ধনিকের জন্য সৃষ্টি করতে হবে মূলধন, যার সাহায্যে ধনিক আরো শ্রমিক শোষণ করতে পারে। তার পরে, তার নিজের খরচে শ্রমের বাজারে স্থাপন করতে হবে একজন সহকারী (locuon tencs’ ) যাকে সরকার সাগর পার করে পাঠিয়ে দেবে তার প্রাক্তন মনিবেরধানকের উপকারের জন্য।