আমরা দেখেছি, জমি থেকে জনসমষ্টির উৎসাদনই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির ভিত্তি রচনা করে। অন্য দিকে, একটি স্বাধীন উপনিবেশের মর্মবস্তু হচ্ছে এই যে, জমির বেশির ভাগটাই এখনো সাধারণের সম্পত্তি, এবং সেই হেতু, তার উপরে বসতি স্থাপনকারী প্রত্যেক ব্যক্তিই সেই সাধারণ জমির একটা অংশকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও নিজস্ব উৎপাদন-উপায়ে রূপান্তরিত করে নিতে পারে; তাতে পরবর্তী বসতি স্থাপনকারীদের পক্ষে অনুরূপ কাজ করার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হয় না।[১০] এটাই হল দুটি ব্যাপারেরই গুপ্ত কথা-উপনিবেশগুলির সমৃদ্ধির এবং তাদের বদ্ধমূল বদভ্যাসের অর্থাৎ মূলধন-প্রতিষ্ঠার প্রতি বিরোধিতার। যেখানে জমি খুব সুলভ এবং সমস্ত মানুষ স্বাধীন, যেখানে যে চায় সে-ই অনায়াসে পেতে পারে এক খণ্ড জমি, সেখানে শ্রম যে কেবল মহার্ঘ, তাই নয়, উৎপন্ন ফসলে শ্রমিকের অংশ প্রসঙ্গে, যে কোনো দামে সম্মিলিত শ্রম সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য।”[১১]
যেহেতু উপনিবেশগুলিতে, শ্রমের অবস্থাবলী থেকে এবং তাদের মূল যে জমি তা থেকে শ্রমিকের বিচ্ছেদ এখনো ঘটেনি, কিংবা, ঘটলেও ঘটেছে কেবল ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে কিংবা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ আয়তনে, সেই হেতু শিল্প থেকে কৃষির বিচ্ছেদও যেমন ঘটেনি, তেমন চাষী সমাজের ঘরোয়া শিল্পেরও বিনাশ ঘটেনি। তা হলে, মূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার কোথা আসবে? আমেরিকার জনসংখ্যার কোনো অংশই একান্তভাবে কৃষিগত নয়, কেবল ক্রীতদাস এবং তাদের নিয়োগকর্তারা ছাড়া, যারা বিশেষ বিশেষ কাজে মূলধন এবং শ্রম সম্মিলিত করে, স্বাধীন আমেরিকানরা, যারা জমি চাষ করে, তারা আরো পাঁচটা পেশা অনুসরণ করে। যেসব আসবাব ও হাতিয়ারপত্র তারা ব্যবহার করে, তার কিছু অংশ তারা নিজেরাই সাধারণতঃ তৈরি করে। তারা প্রায়শই তাদের নিজেদের বাড়ি-ঘর বানিয়ে নেয় এবং তাদের নিজেদের শিল্পোৎপন্ন দ্রব্যসামগ্রী নিজেরাই বাজারে বয়ে নিয়ে যায়-তা সে যত দূরেই হোক না কেন। তারা সুতো কাটে, কাপড় বোনে, তারা সাবান ও মোম তৈরি করে, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যবহারের জুতো-জামাও তৈরি করে। আমেরিকায় জমি চাষ প্রায়ই কর্মকার, ঘানি-ওয়ালা বা দোকানদারের অতিরিক্ত পেশা। [১২] যেখানে এই ধরনের অদ্ভুত লোকজনের বসতি, সেখানে ধনিকদের জন্য “ভোগ-সংবরণের ক্ষেত্ৰ” কোথায়?
ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের মহৎ সৌন্দর্য এইখানে যে, তা কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে মজুরি-শ্রমিককে মজুরি শ্রমিক হিসাবে পুনরুৎপাদন করে না, সেই সঙ্গে সব সময়েই উৎপাদন করে, মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে, মজুরি-শ্রমিকদের একটি আপেক্ষিক উত্ত-জনসংখ্যা। এইভাবে শ্রমের যোগান ও চাহিদাকে ধরে রাখা হয় সঠিক চাপে, মজুরির ওঠা-নামাকে বেঁধে রাখা হয় ধনতান্ত্রিক শোষণের পক্ষে সন্তোষজনক মানার মধ্যে, এবং, সর্বশেষে, ধনিকের উপরে শ্রমিকের সামাজিক নির্ভরতাকে, সেই অপরিহার্য প্রয়োজনকে সুসম্পন্ন করা হয়; নির্ভরতার এক অভ্রান্ত সম্পর্ক, থাকে আত্মতুষ্ঠ রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিক মূল-দেশে তথা স্বদেশে যাদুবলে রূপান্তরিত করতে পারে ক্রেতা, ও বিক্রেতার মধ্যে, সমান ভাবে স্বাধীন দুজন পণ্য-মালিকের মধ্যে-মূলধনরূপ পণ্যের মালিক এবং শ্রমরূপ পণ্যের মালিকের মধ্যে একটি স্বাধীন চুক্তিগত সম্পর্কে। কিন্তু উপনিবেশগুলিতে এই মনোরম কল্পনা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মূল-দেশটির তুলনায় এখানে অনাপেক্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় অনেক বেশি তাড়াতাড়ি, কেননা অনেক এমিক জগতে প্রবেশ করেই আজন্ম-যুবক হিসাবে, এবং তবু শ্রমের বাজারে সব সময়েই ঘাটতি। শ্রমের যোগান ও চাহিদার নিয়ম ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এক দিকে, শোষণ ও “ভোগ সংবরণের তৃষ্ণায় অধীর” পুরনো জগৎ অবিরাম মুলধন ছুড়ে দিচ্ছে; অন্য দিকে, মজুরিশ্রমিক হিসাবে মজুরি-শ্রমিকের নিয়মিত পুনরুৎপাদন সংঘাতে আসছে সবচেয়ে বেয়াড়া এবং অংশতঃ দুর্ভেদ্য সব প্রতিবন্ধকের সঙ্গে। মূলধনের সঞ্চয়নের অনুপাতে সংখ্যাতিরিক্ত মজুরি-শ্রমিকদের উৎপাদনের কি হয়? আজকের মরিশ্রমিক কালকের স্বাধীন চাষী বা কারিগর, যে কাজ করে নিজের জন্য। শ্রমের বাজার থেকে সে উধাও হয়ে যায়। মজুরি-শ্রমিকদের স্বাধীন উৎপাদনকারীতে এই নিরন্তর রূপান্তর, যারা মূলধনের জন্য কাজ করে না, করে নিজেদের জন্য, এবং ধনিক ভদ্রলোকদের সমৃদ্ধ করেনা, করে নিজেদের, এই রূপান্তরণ আবার শ্রমবাজারের পরিস্থিতির উপরে খুব বিকৃত ভাবে প্রতিক্রিয়া করে। মজুরি শ্রমিকদের শোষণের মাত্রা যে কেবল লজ্জাজনক ভাবে নিচু থাকে, তাই নয়। তার উপরে, মজুরিশ্রমিক হারায়, নির্ভরতার সম্পর্ক সমেত, ভোগসংবৃত ধনিকের উপরে তার নির্ভরতার মানসিকতাও। এই কারণেই দেখা দেয় সেইসব অসুবিধা যেগুলিকে আমাদের ই জি ওয়েকফিল্ড চিত্রিত করেছেন এত বলিষ্ঠ ভাবে, এত সোচ্চার ভাবে, এত করুণ ভাবে।
তার নালিশ: মজুরি শ্রমের সরবরাহ স্থিরও নয়, নিয়মিতও নয়, পর্যাপ্তও নয়। “শ্রমের সরবরাহ কেবল অল্পই নয়, অনিশ্চিত।[১৩] যদিও ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিভক্ত উৎপন্ন ফল বেশিও হয়, তা হলেও শ্রমিক এত বড় একটা অংশ নিয়ে নেয় যে, সে অচিরেই একজন ধনিক হয়ে ওঠে। এমনকি যাদের আয়ু খুব দীর্ঘ, তাদের খুব সামান্য কয়েকজনই বিপুল পরিমাণ বিত্ত সঞ্চয় করতে পারে।[১৪] তাদের শ্রমের বৃহত্তর অংশের দাম তাদের দিয়ে দেওয়া থেকে সে নিজের সংবরণ করুক, ধনিককে এই অনুমতি দিতে শ্রমিকেরা অতি স্পষ্ট কণ্ঠে অস্বীকার করে। যদি সে বুদ্ধি করে, তার নিজের মূলধন দিয়ে ইউরোপ থেকে তার নিজের মজুরি-শ্রমিক আমদানি করে, তা হলেও তার কোনো লাভ হয় না। অচিরেই তারা আর ভাড়া-খাটা মজুর থাকে না; যদি শ্রমের বাজারে তাদের প্রাক্তন মনিবদের প্রতিদ্বন্দ্বী না-ও হয়, তারা হয়ে ওঠে স্বাধীন জমিদার[১৫] কী ভয়ংকর ব্যাপার, একবার ভাবুন ত! মহাশয় বনিক ব্যক্তিটি, তার নিজের পকেটের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে, ইউরোপ থেকে শারীরিক ভাবে তুলে এনেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ! দুনিয়ার ইন্তেকালের আর বাকি কি! উপনিবেশ গুলির মজুরি-শ্রমিকদের মধ্য থেকে সমস্ত নির্ভরতা উধাও হয়ে গিয়েছে, এমনকি নির্ভরতার মনোভার পর্যন্ত উধাও হয়ে গিয়েছে-এতে ওয়েকফিল্ড যদি কান্নাকাটি করেন, তা হলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর শিষ মেরিভেল বলেন, উপনিবেশগুলিতে রয়েছে, “আরো সন্তা, আরো বাধ্য মজুরদের জন্য জরুরী দাবি—এমন একটি শ্রেণীর জন্য জরুরী দাবি যাদের হুকুম মানতে ধনিক বাধ্য হবে না, যারা নিজেরাই বাধ্য হবে ধনিকের হুকুম মানতে। প্রাচীন কালের সভ্য দেশগুলিতে শ্রমিক, যদিও স্বাধীন তবু প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা ধনিকদের উপরে নির্ভরশীল ছিল; উপনিবেশগুলিতে এই নির্ভরতা সৃষ্টি করতে হবে কৃত্রিম উপায়ে।[১৬]