প্রথমত, ওয়েকফিল্ড আবিষ্কার করেন যে, উপনিবেশগুলিতে টাকা-পয়সা, জীবন ধারণের উপায়, মেশিন-পত্র এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়ের আকারে সম্পত্তির মালিকানা এখন পর্যন্ত কোন লোককে ‘ধনিক হিসাবে চিহ্নিত করে দেয় না, যদি সেখানে বাকি সহ সম্বন্ধীটি-মজুরি-শ্রমিকটি, যে তার নিজেকে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় বিক্রি করতে বাধ্য সেই মানুষটি-না থাকে। তিনি আবিষ্কার করেন, মূলধন একটা জিনিস নয়, এটা একাধিক ব্যক্তির মধ্যেকার একটা সামাজিক সম্পর্ক, যা প্রতিষ্ঠিত হয় জিনিসের মাধ্যমে।[৪] তিনি দুঃখ করে বলেন, মিঃ পীল তার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, ইংল্যাণ্ড থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়, সোয়ান রিভারে ৫০,০০০ পাউণ্ড মূল্যের জীবন ধারণ ও উৎপাদনের উপায়-উপকরণ। তা ছাড়া, মিঃ পীলের দূরদৃষ্টি ছিল তার সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর পুরুষ, নারী, ও শিশু মিলিয়ে মোট ৩,০০০ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে যাবার একবার তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যাবার পরে, “মিঃ পীলের বিছানা করার মত বা নদী থেকে জল আনবার মত কেউ রইল না।”[৫] অসুখী মিঃ পীল, যিনি সব কিছু ব্যবস্থা করেছিলেন একমাত্র ইংরেজ উৎপাদন-পদ্ধতিতে সোয়ান লেকে রপ্তানি করা ছাড়া!
ওয়েকফিলডের নিম্নোক্ত আবিষ্কারগুলি অনুধাবনের জন্য দুটি প্রাথমিক মন্তব্য: আমরা জানি যে, উৎপাদন ও জীবনধারণের উপায়সমূহ যখন থাকে প্রত্যক্ষ উৎপাদন কারীর সম্পত্তি, তখন তারা মূলধন নয়। তারা মূলধনে পরিণত হয় কেবল সেই অবস্থায়, যখন তারা একই সময়ে শ্রমিকের শোষণ ও বশ্যতাসাধনের উপায় হিসাবে কাজ করে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের মাথার মধ্যে তাদের এই ধনতান্ত্রিক আত্মা তাদের বস্তুগত উপাদানের সঙ্গে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে যে, তিনি সমস্ত অবস্থাতেই তাদের মূলধন বলে অভিহিত করেন—এমনকি যখন তারা তার ঠিক বিপরীত, তখনো। এই হল ওয়েকফিডের ধারণা। অধিকন্তু, নিজের নিজের উদ্যোগে কর্মরত বহুসংখ্যক স্বাধীন শ্রমিকের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে উৎপাদন-উপায় সমূহের বিভক্তিকরণকে তিনি অভিহিত করেন মূলধনের সমবিভাজন হিসাবে। এটা যেমন রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকের ক্ষেত্রে, তেমন সামন্ততান্ত্রিক আইন-বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে। এই আইন-বিশেষজ্ঞেরা সামন্ততান্ত্রিক আইনের কাছ থেকে প্রাপ্ত লেবেলগুলিকেই এটে দিলেন বিশুদ্ধ মুদ্রাকার সম্পর্কের উপরে।
ওয়েকফি বলেন, “যদি ধরে নেওয়া হয় সমাজের সমস্ত সদস্যরা মূলধনের সমান সমান অংশের অধিকারী:…তা হলে কোনো মানুষেরই প্রবৃত্তি হবে না, সে নিজের হাতে যতটা মূলধন ব্যবহার করতে পারে, তার চেয়ে বেশি মূলধন সঞ্চয়ন করার। নোতুন মার্কিন উপনিবেশগুলিতে অবস্থা অনেকটা এইরকম, যেখানে জমির মালিক হবার উন্মাদনা এত প্রবল যে তা শ্রমিকদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে উঠতে দেয় না, যারা ভাড়া খাটবে।”[৬] সুতরাং, যত কাল শ্রমিক নিজের জন্য সঞ্চয়ন করতে পারে–এবং তা সে পারে যত কাল সে থাকে তার উৎপাদন-উপায়ের মালিক, ততকাল ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন ও ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি অসম্ভব। এই সবের জন্য যে মজুরি শ্রমিক-শ্রেণী অত্যাবশ্যক, তা অনুপস্থিত। তা হলে, কেমন করে পুরনো ইউরোপে তার শ্রমের অবস্থাবলী থেকে শ্রমিকের উৎসাদন অর্থাৎ মূলধন এবং মজুরি-শ্রমের সহাবস্থান সংঘটিত হয়েছিল? বেশ মৌলিক ধরনের একটা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে। “মানবজাতি গ্রহণ করেছে: মূলধনের সঞ্চনকে অনুপ্রেরিত করার জন্য একটি সরল কৌশল—মূলধন সঞ্চয়ন, যা অ্যাডাম স্মিথের কাল থেকে ভেসে বেড়িয়েছে তাদের কল্পনায় তাদের অস্তিত্বের একমাত্র ও ও চুড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে তারা নিজেদেরকে ভাগ করে নিয়েছে মূলধনের মালিক এবং শ্রমের মালিকে। এই বিভাগ ছিল সামঞ্জস্য ও সম্মিলনের ফল।”[৭] এক কথায় : “মূলধন সঞ্চয়ন”-এর সম্মানে মানব-সমাজের সুবিপুল জনসমষ্টি নিজেদেরকে সম্পত্তির অধিকার থেকে উৎসাদিত করল। এখন, একজন মনে করবে যে, আত্মবঞ্চনার এই উন্মাদনা নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে জ্যামুক্ত করে দেবে বিশেষ ভাবে উপনিবেশগুলিতে, একমাত্র যেখানে থাকে এমন মানুষজন এবং আয়োজন, যা সামাজিক চুক্তিকে পরিণত করতে পারে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে। কিন্তু তা হলে কেন “প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার”-কে ডেকে আনা হবে তার বিপরীত, স্বতঃস্ফুর্ত, অনিয়মিত উপনিবেশ বিস্তারকে প্রতিস্থাপিত করার জন্য? কিন্তু কিন্তু-“আমেরিকান ইউনিয়নের উত্তর দিককার অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিতে জনসংখ্যা এমনকি এক-দশমাংশের মতও ভাড়াটে শ্রমিকের পংত্তির মধ্যে পড়ে কিনা সন্দেহ। ইংল্যাণ্ডে …শ্রমজীবী শ্ৰেণীই গঠন করে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টি।[৮] এমনকি, শ্রমজীবী মানবসমাজের পক্ষে মূলধনের মহিমার জন্য আত্ম-উচ্ছেদনের এই প্রবৃত্তি এত সামাই থাকে যে, স্বয়ং ওয়েকফিতের মতেও, ক্রীতদাসত্বই ঔপনিবেশিক ঐশ্বর্যের স্বাভাবিক ভিত্তি। তাঁর প্রণালীবদ্ধ উপনিবেশবিস্তার হল কেবল একটা pis aller ( ‘অগতির গতি ), যেহেতু দুর্ভাগ্যক্রমে তাকে কাজ চালাতে হয়, ক্রীতদাসদের দিয়ে নয়, স্বাধীন মানুষদের নিয়ে। “সেন্ট ভোমিনিগোতে প্রথম স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনকারীরা স্পেন থেকে শ্রমিক পায়নি। কিন্তু শ্রমিক ছাড়া, তাদের মূলধন নিশ্চয়ই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিংবা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে সেই ক্ষুদ্র পরিমাণটিতে পর্যবসিত হয়েছিল, যতটা প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার নিজের হাতে কাজে লাগাতে পারে। এটা সত্য সত্যই ঘটেছিল ইংরেজদের দ্বারা স্থাপিত সর্বশেষ উপনিবেশটিতে-সোয়ান লেক-এ, যেখানে এক বিপুল পরিমাণ মূলধনবীজ, উপকরণ ও গবাদি পশু-ধ্বংস হয়ে গিয়েছে সেগুলি ব্যবহার করার মত শ্রমিক ছিলনা এবং যেখানে কোনো বসতি স্থাপন কারী নিজের হাতে—যতটা মূলধনকে কাজে লাগাতে পারে তার চেয়ে বেশি মূলধন রক্ষা করেনি।”[৯]