১২. ১৭৯০ সালে ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন করে স্বাধীন লোক-পিছু ছিল ১০ জন করে ক্রীতদাস, ফ্রেঞ্চ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ১৪ জন, ডাচ ওয়েস্ট ইণ্ডিজে একজন-পিছু ২৩ জন। (হেনরি ব্রাউহাম, ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দি কলোনিয়াল পলিসি অব দি ইউরোপীয়ান পাওয়ার্স’, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ ৭৪)।
১৩. যখন থেকে মজুরি-শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভাব হল তখন থেকে ইংরেজ আইনে মেহনতি গরিব’ কথাটির প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। কথাটা ব্যবহার করা হয়, একদিকে, অলস গরিব, ভিখারী ইত্যাদি থেকে, অন্য দিকে, সেই সব শ্রমিক যারা এখন তাদের উৎপাদন-উপায়সমূহ থেকে বঞ্চিত হয়নি, সেই পায়রা যাদের পালক এখনো তুলে নেওয়া হয়নি, তাদের সঙ্গে পার্থক্য বোঝাতে। আইনের বই থেকে কথাটা চালু হয়ে গেল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এবং কালপেপার, জে চাইল্ড প্রভৃতির কাছ থেকে উত্তরাধিকার হিসাবে এল অ্যাডাম স্মিথ এবং ইডেনের হাতে। এর পরে যে-কেউ সেই জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর-বাগীশ’ এডমণ্ড বার্ক-এর সরল বিশ্বাসের বিচার করতে পারেন, যখন তিনি মেহনতি গরিব’ কথাটাকে অভিহিত করেন জঘন্য রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর’ বলে। এই মোসাহেবটি, যিনি একদা আমেরিকান কলোনি গুলির বেতন-ভোগী হিসাবে আমেরিকার অশান্তির সূচনাকালে ইংরেজ-অভিজাত তন্ত্রের উদারনীতিকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, পরে আবার ইংরেজ অভিজাত তন্ত্রের বেতন-ভোগী হয়ে ফরাসী বিপ্লবের বিরুদ্ধে ভাবপ্রবণ অতীত-বিলাসীর ভূমিকা গ্রহণ করেন, আসলে হলেন একজন পুরোপুরি স্কুলচরিত্র বুর্জোয়।।
‘বাণিজ্যের নিয়মাবলী হল প্রকৃতির নিয়মাবলী; অতএব বিধাতার নিয়মাবলী। (এডমণ্ড বার্ক, থটস অ্যাণ্ড ডিটেলস অন স্কেয়্যারসিটি, পৃ ৩১, ৩২)। আশ্চর্য কি যে, বিধাতা ও প্রকৃতির নিয়মাবলীর প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে তিনি সব সময়েই নিজেকে সবচেয়ে ভাল বাজারে বিকিয়েছেন। এই বার্ক সাহেব যখন উদারনীতিক ছিলেন, সে সময়ে তাঁর এক অতি সুন্দর চিত্র পাপ্পা যায় রেভারেণ্ড টাকায়-এর লেখায়। টাকার ছিলেন একজন যাজক এবং একজন টোরি, কিন্তু, তা ছাড়া বাকি ক্ষেত্রে একজন শ্রদ্ধার্থ ব্যক্তি ও সুযোগ্য অর্থনীতিবিদ। যে কলংকজনক কাপুরুষতা আজ রাজত্ব করছে এবং বাণিজ্যের নিয়মাবলী’-তে অতিশয় ভক্তিভরে বিশ্বাস রাখছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হল বার্ক-এর মত লোকগুলিকে চিহ্নিত করা—যারা তাদের পরবর্তীদের থেকে সব বিষয়েই আলাদা, একমাত্র প্রতিভার বিষয়ে ছাড়া।
১৪. Marie Augier; “Du Credit Public. Paris, 1842.
১৫. ‘কোয়ার্টালি’ পত্রিকার একজন লেখক বলেছেন, মূলধন বিক্ষোভ এবং বিবোধ ছড়ায় এবং তা শংকাপ্রবণ; কথাটা খুবই সত্য; কিন্তু এটা একটা অসম্পূর্ণ বক্তব্য। মূলধন কোনো মুনাফাকে, বা ক্ষুদ্র মুনাফাকেও, পরিহার করে না, ঠিক যেমন প্রকৃতির সম্পর্কে আগে বলা হত যে সে শূন্যতাকে প্রত্যাখ্যান করে। পর্যাপ্ত মুনাফা সহ মূলধন খুবই সাহসী। শতকরা ১০ ভাগ যে কোন জায়গায় তার বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে। শতকরা ২০ ভাগ সৃষ্টি করবে ব্যগ্রতা; শতকরা ৫০ ভাগ, প্রত্যক্ষ ঔদ্ধত্য; শতকরা ১০০ ভাগ তাকে তৎপর করে তুলবে মানুষের সমস্ত আইনকে মাড়িয়ে যেতে; শতকরা ৩০ ভাগ হলে তো এমন কোনো অপরাধ নেই যা করতে তার কুণ্ঠা হবে, এমন কোনো ঝুকি নেই যা নিয়ে সে পিছ-পা হবে—এমনকি তাতে যদি তার মালিকের ফাসিতে ঝুলতে হয়, তা হলেও পবোয়া নেই। যদি বিক্ষোভ এবং বিরোধ মুনাফা নিয়ে আসে, তা হলে সে অবাধে দুটোতেই প্রবোচনা যোগাবে। যা বলা হয়, চোরাচালান আর দাস ব্যবসা তা প্রচুরভাবে প্রমাণ করেছে।” (টি. রে জনিং, “ট্রেস ইউনিয়ন্স অ্যাণ্ড স্ট্রাইক দেয়ার ফিলসফি অ্যান্ড ইন্টেনশন, ১৮৬, পৃ ৩৫-৩৬)।
৩২. ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা
দ্বাত্রিংশ অধ্যায়–ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়নের ঐতিহাসিক প্রবণতা
মূলধনের আদিম সঞ্চয়ন অর্থাৎ তার ঐতিহাসিক উৎপত্তি নিজেকে কিসে পর্যবসিত করে? যতদূর পর্যন্ত তা ক্রীতদাস ও ভূমিদাসদের মজুরি-শ্রমিকে প্রত্যক্ষ রূপান্তরণ নয় এবং সেই কারণে নিছক রূপগত পরিবর্তন মাত্র, ততদূর পর্যন্ত তার অর্থ দাড়ায় উৎপাদনকারীদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বিচ্যুতিকরণ অর্থাৎ মালিকের নিজের শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তি সাধন। সামাজিক তথা সামূহিক সম্পত্তির বিপরীত হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিদ্যমান থাকে কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমের উপায়সমূহ এবং শ্রমের বাহিক অবস্থাবলী ব্যক্তির মালিকানা-ভুক্ত। কিন্তু এই ব্যক্তি শ্রমিক কি শ্রমিক নয়, তদনুযায়ী সম্পত্তির চরিত্রও বিভিন্ন হয়। অসংখ্য ধরন-ধারণ, যেগুলি প্রথমে চোখের সামনে হাজির হয়, সেগুলি এই দুটি চরম রূপের মধ্যবর্তী বিভিন্ন পর্যায়। নিজের উৎপাদনের উপায়সমূহের শ্রমিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল ক্ষুদ্র শিল্পের ভিত্তি, তা সে কৃষিগই হোক বা ম্যানুফ্যাকচারগতই হোক বা উভয়গতই হোক; আবার এই ক্ষুদ্র শিল্পই হল সামাজিক উৎপাদনের বিকাশ এবং স্বয়ং শ্রমিকের স্বাধীন ব্যক্তিত্বের বিকাশের অত্যাবশ্যক শর্ত। অবশ্য, এই ক্ষুদ্র উৎপাদন পদ্ধতি ক্রীতদাসত্ব ভূমিদাসত্ব ও অন্যান্য ধরনের অধীনত্বের অবস্থাতেও বিরাজ করে। কিন্তু তা বিকাশিত হয়, তার সমগ্র শক্তিকে মুক্ত করে দেয়, তার চিরায়ত রূপে উপনীত হয় কেবল সেখানেই, যেখানে শ্রমিক নিজেই তার শ্রমের উপায়সমূহের ব্যক্তিগত মালিক এবং যেখানে সে নিজেই সেগুলিকে গতি-সচল রাখে। জমির চাষী যে নিজেই জমিটি চাষ করে, হাতিয়ারের কারিগর যে নিজেই তা ব্যবহার করে বিশেষজ্ঞ হিসাবে। এই উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বশর্ত হল এই যে জমি থাকবে ভাগে ভাগে এবং উৎপাদনের অন্যান্য উপায়গুলি থাকবে ছড়িয়ে। এক দিকে যেমন তা এই সমস্ত উৎপাদন-উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবনকে ঠাই দেয় না, অন্য দিকে তেমন তা শাবার সহযোগ, উৎপাদনের প্রত্যেকটি প্রক্রিয়ার মধ্যে শ্রম-বিভাজন, সমাজ কর্তৃক প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের উৎপাদনশীল প্রয়োগ ও সেগুলির উপরে নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক উৎপাদিকা ক্ষমতার অবাধ বিকাশ ইত্যাদিকেও ঠাই দেয় না। তা কেবলি এমনি একটা উৎপাদন-ব্যবস্থার সঙ্গে তথা সমাজের সঙ্গে, সঙ্গতিপূর্ণ, যা সংকীর্ণ এবং মোটামুটি আদিম চৌহদ্দির মধ্যেই নড়াচড়া করে। অকে চিরস্থায়ী করার মানে দাঁড়াবে, যে-কথা পেকুয়র সঠিক ভাবেই বলেছেন, “সর্বজনীন সাধারণত্বের বিধান জারি করা।”