ম্যানুফ্যাকচার-আমলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের জনমত লজ্জা ও বিবেকের শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল। ধনতান্ত্রিক সনের উপায় হিসাবে কাজ করে এমন প্রত্যেকটি অপকর্ম সম্পর্কে জাসিমূহ কুণ্ঠাহীন ভঙ্গিতে দন্ত করে বেড়াত। নমুনা হিসাবে পড়ুন কীর্তিমান এ এভারসন-এর সাদামাঠা বাণিজ্য বিবরণী’ ( ‘অ্যানালস অব কমার্স’ )। ইউট্রেক্ট-এর যে শান্তিচুক্তিতে ইংল্যান্ড আসিয়েন্টো-সন্ধির দ্বারা স্প্যানিয়ার্ডদের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল আফ্রিকা ও স্প্যানিশ আমেরিকার মধ্যেও দাস-ব্যবসা চালাবার অধিকার, যা তখন পর্যন্ত পরিচালিত হত কেবল আফ্রিকা এবং ইংলিশ ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মধ্যে সেই চুক্তিকে এখানে তূর্যনাদে ঘোষণা করা হয়েছে ইংরেজ কূটনীতির জয়জয়কার বলে। এতদ্বারা ইংল্যাণ্ড ১৭৪৩ সাল অবধি স্প্যানিশ আমেরিকাকে বাৎসরিক ৪,৮০০ জন করে নিগ্রো সরবরাহে অধিকার অর্জন করে। এর ফলে একই সঙ্গে ব্রিটেনের চোরাচালান একটা সরকারি ছদ্ম আবরণে আবৃত হয়। দাস-ব্যবসায়ের সুবাদে লিভারপুল ফুলে উঠল। এটাই হল তার আদিম সঞ্চয়নের পদ্ধতি। এবং আজও পর্যন্ত লিভারপুল-“আভিজাত্য” হল দাশ-ব্যবসায়ের ‘পিণ্ডার’, যা—পুর্বোদ্ধত আইকিন-এর রচনার সঙ্গে (১৭৯৫) তুলনীয়—“যে-দুঃসাহসিক অভিযানের তাড়না লিভারপুলের ব্যবসাকে বিশেষিত করেছে এবং তাকে দ্রুত বেগে বর্তমান সমৃদ্ধির অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে, তার সঙ্গে সাযুজ্য লাভ কয়েছে, জাহাজ ও নাবিকদের জন্য বিপুল কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে এবং দেশের ম্যানুফ্যাকচারের জন্য চাহিদা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি করেছে।” (পৃঃ ৩৩৯) লিভারপুল দাস-ব্যবসায়ে নিয়োগ করেছিল, ১৭৩০ সালে ১৫টি জাহাজ, ১৭৫১ সালে ৫৩টি, ১৭৬০ সালে ৭৪টি, ১৭৭০ সালে ৯৬টি এবং ১৭৯২ সালে ১৩২টি।
যখন তুলা-শিল্প ইংল্যাণ্ডে প্রবর্তন করল শিশু-ক্রীতদাসত্ব, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণা সঞ্চার করল পূর্বতন, কম-বেশি, পিতৃতান্ত্রিক ক্রীতদাসত্বের একটি বাণিজ্যিক শোষণ-ব্যবস্থায় রূপান্তর-পরিগ্রহে। বস্তুতঃ পক্ষে, ইউরোপে মজুরি-শ্রমিকদের অবগুণ্ঠিত ক্রীতদাসত্বের পাদপীঠ হিসাবে তার প্রয়োজন ছিল নোতুন জগতে বিশুদ্ধ ও সরল ক্রীতদাসত্বের। [১২]
Tante molis erat, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের “শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠা করতে, শ্রমিক এবং তার শ্রমের অবস্থাবলীর মধ্যে বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে, এক মেরুতে উৎপাদন ও প্রাণ-ধারণের উপায়সমূহকে মূলধন এবং বিপরীত মেরুতে জনসংখ্যার বিপুল সমষ্টিকে আধুনিক সমাজের কৃত্রিম সৃষ্টি সেই মজুরি-শ্রমিকে তথা “মুক্ত মেহনতি গরিব মানুষে” রূপান্তরিত করতে।[১৩] যদি অর্থ, অজিয়ার যে কথা বলেছেন, “পৃথিবীতে আসে তার এক গালে জন্মগত রক্তচিহ্ন নিয়ে[১৪] তা হলে মূলধন আসে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, প্রত্যেকটি লোমকূপ থেকে ফোটা ফোটা রক্ত ও ক্লেদ ঝরাতে ঝরাতে।”[১৫]
————
১. ‘শিল্প কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে কৃষি’-র সঙ্গে পার্থক্যসূচক হিসাবে। বর্গগত’ অণে কৃষি-মালিক’ ম্যানুফ্যাকচারকারীর মতই একজন শিল্প-খনিক।
২. “দি ন্যাচারাল অ্যাণ্ড আর্টিফিসিয়াল রাইটস অব প্রপার্টি কন্ট্রাস্টেড’, লণ্ডন, ১৮৩২, পৃঃ ১৮-৯৯। অনামী বইটির লেখকের নাম : “টমাস হজস্কিন”।
৩. এই ১৭৯৪ সালেও লীডস-এর বস্তু-প্রস্তুতকারকেরা পার্লামেন্টের কাছে এমন একটি আবেদনসহ প্রতিনিধিমণ্ডলী প্রেরণ করেন, যাতে কোন বণিক ম্যানুফ্যাকচারে পরিণত না হয় সেইরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। (ডঃ আইকিন, ঐ)
৪. উইলিয়াম হাউইট : কলোনাইজেশন অ্যাণ্ড ক্রিশ্চিয়ানিটি : এ পপুলার হিষ্ট্রি অব দি ট্রিটমেন্ট অব নেটিভস বাই দি ইউরোপীয়ানস ইন অল দেয়ার কলোনিজ, ১৮৩৮, পৃঃ ৯। ক্রীতদাসদের প্রতি আচরণ সম্পর্কে চালস কোং-এর ‘ব্রেইতে দ্য লা লিজিলে’-এ একটি ভাল সংকলন রয়েছে। যেখানেই বুর্জোয়া শ্রেণী বিনা-বাধায় তার নিজের ছাচ অনুযায়ী বিশ্বকে তৈরি করে নিতে পারে সেখানে সে তার নিজের অন্য এবং শ্রমিকের জন্য কি করে, তা দেখার জন্য এই বইটি বিস্তারিত ভাবে পাঠ করা উচিত।
৫. টমাস স্ট্যামফোর্ড ব্যালস, ঐ দ্বীপটির প্রাক্তন গভর: “দি হি অব জাভা, লণ্ডন, ১৮১৭।
৬. ১৮৬৬ সালে একমাত্র উড়িষ্যা প্রদেশেই ক্ষুধায় মারা যায় ১০ লক্ষাধিক হিন্দু (অর্থাৎ ভারতীয়-বাং অনুঃ)। যাই হোক, চেষ্টা হয়েছিল অনাহার-ক্লিষ্ট মানুষগুলিকে যে-দামে প্রাণ-ধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যাদি বিক্রি করা হয়েছিল, তা দিয়ে ভারতের রাজকোষকে সমৃদ্ধ করে তুলবার।
৭. উইলিয়ম কবেট মন্তব্য করেন, ইংল্যাণ্ডে সমস্ত পাব্লিক’ ( ‘সার্বজনিক) প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় “বাল (রাজকীয়’ ); যাই হোক, তার ক্ষতিপূরণ হিসাবে রয়েছে ন্যাশনাল’ (জাতীয়) ঋণ।
৮. “Si les Tartares inonbaient l’Europe anjourd’hui, il faudrait bien des affaires pour leur faire entendre ce que c’est qu’un flnancier parmi nous.” Montesqnieu, “Esprit des lois.” t. iv., p. 33. oda Londres, 1769.
৯. মিরাবো, ঐ, পৃ ১০১।
১০. ইভেন, ঐ, প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৪২১।
১১. জন ফিলডেন, ‘দি কার্স অব দি ফ্যাক্টরি সিস্টেম, পৃঃ ৫৬। ফ্যাক্টরি ব্যবস্থার গোড়ার দিককার কেলেংকারিগুলির জন্য দেখুন ডঃ আইকিন-এর ‘ডেস্ক্রিপশন অব দি কান্তি’ পৃ: ২১৯, এবং জিসবোন-এর ‘এনকুইরি ইনটু দি ডিউটিজ অব মেন’, দ্বিতীয় খণ্ড। যখন স্টিম-ইঞ্জিন ফ্যাক্টরিগুলিকে পল্লী-গ্রামের জলপ্রপাতগুলি থেকে শহরের মধ্যস্থলে স্থানান্তরিত করল, তখন ‘কৃচ্ছ সাধক উদ্বৃত্ত-মূল্য-প্রস্তুতকারক শিশু সামগ্রীকে পেয়ে গেল হাতের কাছে তৈরি অবস্থায়; দুঃস্থ-নিবাসগুলি থেকে গোলাম সংগ্রহ করতে বাধ্য হতে হল না। যখন স্যার আর পীল (আপাত-ন্যায্যতার মন্ত্রী মহোদয়’-এর পিতা) ১৮১৫ সালে শিশুদের সুরক্ষার জন্য বিল উত্থাপন করলেন, তখন ‘বুলিয়ন-কমিটি’র নক্ষত্র এবং রিকার্ডোর অন্তরঙ্গ বন্ধু হনার কমন্স সভায় বলেন : এটা কলংকজনক যে, একজন দেউলিয়ার জিনিসপত্রের সঙ্গে শিশুদের একটা দলকে ( যদি তাকে কথাটা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়। বিক্রির জন্য হাজির করা হয়েছে এবং ঐ সম্পত্তির একটা অংশ হিসাবে প্রকাশ্যেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। দু বছর আগে কোর্ট অব কিংস বেঞ্চ’-এর সমক্ষে একটা অত্যন্ত নৃশংস দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়েছিল, যাতে লণ্ডনে এক ম্যানুফ্যাকচারারের কাছে প্যারিশ কর্তৃক শিক্ষানীশির জন্য প্রেরিত কিছু সংখ্যক বালক অপর একজনের কাছে হস্তান্তরিত হয় এবং কয়েকজন সদাশয় ব্যক্তির দ্বারা চরম দুর্ভিক্ষ-ক্লিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। যখন তিনি একটি পালামেন্টারি কমিটিতে ছিলেন, তখন আরেকটি ঘটনা তার গোচরে আসে বেশি বছর আগে নয় এক লণ্ডন-প্যানিশ এবং একজন ল্যাংকাশায়ারম্যানুফ্যাকচারারের মধ্যে এক চুক্তি হয় যে প্রত্যেক ২০টি শিশুর সঙ্গে একটি করে জড়বুদ্ধি শিশুকে নিতে হবে।