শিল্প-খনিকের উৎপত্তি সোচ্চারে প্রশ্ন করেন, “কেন, কেন যাচ্ছেন অতদূরে যুদ্ধের আগেকার স্যাল্পনির শিল্প গৌরবের উৎস সন্ধানে? সে উৎস হল সার্বভৌমদের দ্বারা গৃহীত ১৮,০০,০০,০০০ (আঠারো কোটি) পরিমাণ ঋণের সম্ভার।[৯]
ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা, জাতীয় ঋণ, গুরুভার কর, সংরক্ষণ, বাণিজ্যিক যুদ্ধ ইত্যাদি যথার্থ ম্যানুফ্যাকচারার-আমলের এই সন্তানেরা আধুনিক শিল্পের শৈশবকালে সুবিপুল ভাবে বৃদ্ধি লাভ করে। দ্বিতীয়টির আবির্ভাব সূচিত হয় নিপদের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। রাজকীয় নৌবাহিনীর মত কারখানাগুলিও ভর্তি করা হয়েছিল তোক ফুসলানো দালালদের মারফৎ। পঞ্চদশ শতকের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে তার নিজের কাল পর্যন্ত জমি থেকে কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ সাধনের ভয়াবহ ঘটনাবলীতে স্যার এফ. এম. ইডেন আনন্দে আকুল; ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং আবাদি জমি ও চারণ ভূমির মধ্যে যথোচিত অনুপাত” রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক এই প্রক্রিয়ায় তিনি আত্মতৃপ্তিতে উৎফুল; তবু কিন্তু তিনি ম্যানুফ্যাক্টরি-শোষণকে ফ্যাক্টরি-শোষণে রূপান্তর-সাধন এবং মূলধন ও শ্রমশক্তির মধ্যে “যথার্থ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য শিশু-চুরি ও শিশু-গোলামি সম্পর্কে একই অর্থনৈতিক অন্তদৃষ্টি দেখাননি। তিনি বলেন, এটা হয়তো সাধারণের বিচার-বিবেচনার উপযুক্ত বিষয় বলে গণ্য হবে যে, কোনো ম্যানু ফ্যাকচারের সফল পরিচালনার জন্য কুটির ও দুঃস্থ-নিবাসগুলিতে হানা দিয়ে গরিব শিশুদের ধরে আনা, রাতের বেশির ভাগ সময় তাদের দিয়ে পালাক্রমে কাজ করানো এবং যে-বিশ্রামটুকু সকলের পক্ষেই অত্যাবশ্যক কিন্তু সবচেয়ে বেশি আবশ্যক ছোটদের জন্য, তা থেকে তাদের বঞ্চিত করা প্রয়োজন কিনা; বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন মানসিকতার ছেলে এবং মেয়েদের এমন ভাবে এক জায়গায় জড় করা হয় যে একজনের দৃষ্টান্ত অন্য জনে সংক্রামিত হয়ে দুশ্চবিত্রতা ও লাম্পট্যের প্রসার না ঘটিয়ে পারে কিনা, এই সব কিছু যোগ করলে ব্যক্তিগত বা জাতিগত শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে পারে কিনা।”[১০]
ফিডেল বলেন, “ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ার কাউন্টিগুলিতে, বিশেষ করে, শেষোক্তটিতে, নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনারি ব্যবহৃত হত বড় বড় কারখানা গুলিতে, যেগুলি নির্মাণ করা হতো সেই সব নদীর তীরে, যেখানে জল-চক্র ঘোরানো সম্ভব হয়। এই সব জায়গায় সহসা দরকার পড়ত লক্ষ লক্ষ কর্মীর-শহর থেকে অনেক অনেক দূরে; এবং তখন ল্যাংকাশায়ার অপেক্ষাকৃত উর্বর ও জনবিরল থাকার জন্য, সে শুধু চাইত যে তার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাক। ছোট ঘোট ছেলেমেয়েদের ছোট ছোট ও চটপটে আঙুলগুলির চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি; সঙ্গে সঙ্গেই একটা প্রথা গড়ে উঠল লণ্ডন, বাকিংহাম ও অন্যান্য জায়গার প্যারিশের এখতিয়ারভুক্ত দু-নিবাসগুলি থেকে শিক্ষানবিশ সংগ্রহ করার। ৭ থেকে ১৩-১৪ বছর বয়সের এমন হাজার হাজার অল্পবয়সী হতভাগ্য ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে দেওয়া হল সুদূর উত্তরে। রীতি ছিল এই যে, মনিব তাদের খাওয়া-পরা দেবে এবং কারখানার কাছেই একটি ‘শিক্ষানবিশ-নিবাসে থাকার জায়গা দেবে; কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য তদারক কারী নিযুক্ত করা হত, যাদের একমাত্র স্বার্থ ছিল কত বেশি করে ছেলে-মেয়েদের খাটানো যায়, কেননা তাদের বেতন ছিল তারা, কত পরিমাণ কাজ আদায় করে নিতে পারে, তার আনুপাতিক। স্বভাবতই এর পরিণামে ঘটত নিষ্ঠুরতা। অনেক ম্যানুফ্যাকচারকারী জেলাতেই, বিশেষ করে আমি যে-জেলার লোক সেই অপরাধী জেলাটিতে (ল্যাংকাশায়ারে), আমার বলতে কুণ্ঠা হচ্ছে, এই নিরীহ নিঃসহায় প্রাণী গুলির উপরে-যাদের সঁপে দেওয়া হয়েছিল মালিক-ম্যানুফ্যাকচারের হাতে, তাদের উপরে—অনুষ্ঠিত হত সবচেয়ে হৃদয়বিদারক নিষ্ঠুরতা; অতিরিক্ত কাজের চাপে তাদের পিষে ফেলা হত নাভিশ্বাস না ওঠা পর্যন্ত : চাবুক মারা হত, শিকল পরানো হত এবং নির্যাতন করা হত নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে নিখুত সুসংস্কৃত পদ্ধতিতে;…অনেক সময়ে চাবুক মেরে মেরে কাজ করানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের একদম উপোস করিয়ে রাখা হত
… এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হত। : সাধারণের দৃষ্টির অন্তরালবর্তী ডার্বিশায়ার, নটিংহামশায়ার ও ল্যাংকাশায়ারের মনোরম ও কাব্যময় উপত্যকাগুলি পরিণত হল অত্যাচারের বিষন্ন বিজন প্রান্তরে। ম্যানুফ্যাকচার কারীদের মুনাফা হল বিপুল; কিন্তু তার ফলে, যে-ক্ষুধা তৃপ্ত হওয়া উচিত ছিল, তা আরো তীব্র হয়ে উঠল; আর তাই ম্যানুফ্যাকচারকারীরা এমন একটা কৌশল অবলম্বন করল যা তাদের সীমাহীন ভাবে মুনাফা এনে দেবে বলে মনে হল; তারা, যাকে বলে রাতের কাজ” তার প্রচলন করল, অর্থাৎ সারা দিন এক প্রস্ত শ্রমিককে খাটিয়ে ক্লান্ত করে দিয়ে, তারা আর এক প্রস্ত শ্রমিককে সারা রাত খাটাবার জন্য লাগিয়ে দিত; রাতের প্রস্ত যে-বিছানাগুলি সবে মাত্র ছেড়ে গিয়েছে, দিনের প্রস্ত সেই বিছানাগুলিতে গিয়ে শুয়ে পড়ত; আবার তাদের তাদের পালা শেষ করে দিয়ে রাতে প্রস্ত এসে সেই বিছানাগুলিতে শুয়ে পড়ত, যেগুলি সকাল বেলা দিনের প্রন্ত ছেড়ে গিয়েছে। ব্যাংকাশায়ারে এটা একটা চতি রীতি যে বিছানাগুলি কখনো ঠাণ্ডা হয়না।”[১১]