বিভিন্ন জাতীয় নামে শোভিত বড় বড় ব্যাংকগুলি তাদের জন্মকালে ছিল কেবল ব্যক্তিগত ফটকাবাজদের সংগঠন; তারা নিজেদের স্থাপন করত সরকারের পাশাপাশি এবং যে-সমস্ত সুযোগ-সুবিধা তারা পেত, তার দৌলতে সক্ষম হত তার রাষ্ট্রকে অর্থ অগ্রিম দিতে। সুতরাং এই সব ব্যাংকে উত্তরোত্তর স্টক-বৃদ্ধির তুলনায় জাতীয় ঋণের অধিকতর অভ্রান্ত পরিমাপ আর কিছু নেই; এই ব্যাংকগুলির পূর্ণ বিকাশের সূচনা হয় ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’-এর প্রতিষ্ঠা থেকে। ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ শুরু করল সরকারকে ৮ শতাংশ হারে টাকা ধার দেওয়া থেকে; একই সময়ে পার্লামেন্ট তাকে ক্ষমতা দিল, ব্যাংক-নোটের আকারে জনগণকে ধার দিয়ে, ঐ একই মূলধন থেকে টাকা তৈরি করার। সে ক্ষমতা পেল ‘বিল’ ভাঙানোর জন্য, পণ্য বাবদে আগাম দেবার জন্য, মূল্যবান ধাতু ক্রয় করার জন্য এই নোট ব্যবহার করতে। কিছুকাল যেতে না যেতেই, স্বয়ং ব্যাংক কর্তৃক তৈরি করা এই ঋণগত অর্থ ( ক্রেডিট মানি’) পরিণত হল মুদ্রায় যার সাহায্যে ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ড’ রাষ্ট্রকে ধার দিত এবং, রাষ্ট্রের পক্ষে, জাতীয় ঋণের সুদ দিত। এটাই যথেষ্ট ছিল না যে ব্যাংক এক হাতে যা দিত, অন্য হাতে তার চেয়ে বেশি নিত; সে থেকে যেত এমনকি যখন সে ফেরৎ পেতে থাকত, তখনো জাতির শাশ্বত ঋণদাতা, অগ্রিম-প্রদত্ত শেষ শিলিংটি পর্যন্ত। ক্রমে ক্রমে অনিবার্য ভাবেই সে পরিণত হল দেশের ধাতব সঞ্চয়ের ভাণ্ডারে এবং সমস্ত বাণিজ্যিক ঋণের অভিকর্ষণ-কেন্দ্রে। ব্যাংক-মালিক, ফিনান্সিয়ার, অ্যানুইটি’-ভোগী দালাল, ফটকাবাজ ইত্যাদির একটা গোটা গোষ্ঠীর এই আকস্মিক অভ্যুদয়ের কি ফলাফল সম-সাময়িকদের ঘটেছিল, তা সে সময়কার লেখাজোখা থেকে প্রমাণ হয়, যেমন বলিং-ব্রোক এর লেখা। [৮]
জাতীয় ঋণের সঙ্গে উদ্ভূত হল একটা আন্তর্জাতিক ঋণ-ব্যবস্থা, যা অনেক সময়েই প্রচ্ছন্ন রাখে এই বা ঐ জাতির আদিম সঞ্চয়নের একটি উৎস। যেমন ভেনিসীয় চৌর্য-ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য ছিল ইংল্যাণ্ডের মূলধনসম্পদের একটি গোপন উৎস, যাকে ভেনিস তার অবক্ষয়ের সময়ে প্রচুর অর্থ ধার দিয়েছিল। হল্যাণ্ডে এবং ইংল্যাণ্ডের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। আঠারো শতকের গোড়ার দিকেই ওলন্দাজ ম্যানুফ্যাকচার অনেক পেছনে পড়ে গেল। শিল্প-বাণিজ্যে অগ্রগামী দেশ হিসাবে হল্যাণ্ডের যে-স্থান ছিল, তা আর রইল না। সুতরাং ১৭০১ থেকে ১৭৭৬ পর্যন্ত তার ব্যবসার অন্যতম প্রধান ধারা হল বিরাট বিরাট পরিমাণ মূলধন ধার দেওয়া, বিশেষ করে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটেনকে। সেই একই জিনিস আজ চলছে ইংল্যাণ্ড আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যে। জন্মের প্রমাণপত্র ছাড়া যে-বিপুল পরিমাণ মূলধন আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দেখা। যায়, গতকাল তা ছিল শিশুদের ধনতান্ত্রিক বক্ত!
যেহেতু জাতীয় ঋণ তার অবলম্বন প্রাপ্ত হয় সরকারি রাজষের মধ্যে, যাকে অবশ্যই সুদ ইত্যাদি বাবদ বাংলরিক ব্যয় বহন করতে হবে, সেহেতু আধুনিক কর-ব্যবস্থা পরিণত হয়েছে ঋণ-ব্যবস্থার আবশ্যিক পরিপূরকে। ঋণ-গ্রহণের সাহায্যে সরকার সক্ষম হয় তার অস্বাভাবিক ব্যয়গুলি এমন ভাবে নির্বাহ করতে যাতে করে করদাতারা তৎক্ষণাৎ তা অনুভব না করে, কিন্তু তার দরুন কালক্রমে অবশ্যই করবৃদ্ধি ঘটে। অন্য দিকে, একটার পরে একটা যেসব ধার পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে, তার ফলে যে কর-বৃদ্ধি ঘটে, তা সব সময়েই সরকারকে বাধ্য করে নোতুন নোতুন অস্বাভাবিক ব্যয় নির্বাহের জন্য নোতুন নোতুন ধানের আশ্রয় গ্রহণ করতে। আধুনিক রাজস্ব-সংক্রান্ত নীতি, যার ভিত্তি হল জীবনধারণের অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর উপরে কর-আরোপন ( ফলতঃ সেগুলির দামের বৃদ্ধি-সাধন), এইভাবে নিজের মধ্যেই ধারণ করে ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্তির বীজ। অতিরিক্ত কর একটা আকস্মিক ঘটনা নয়, একটা আচৰিত নীতি। সুতরাং, যেখানে এই ব্যবস্থার প্রথম প্রবর্তন ঘটেছিল, সেই হল্যাণ্ডের মহান দেশপ্রেমিক ডে উইট তার নীতি-বাণীতে একে মজুরি-শ্রমিককে বিনয়ী, মিতব্যয়ী, পরিশ্রমী ও শ্রম-ভারে অতি-ভারাক্রান্ত করার সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবস্থা হিসাবে অভিনন্দিত করেছেন। যাই হোক, এই ব্যবস্থা চাষী কারিগর, এক কথায়, নিম্নতর মধ্য-শ্রেণীর সমস্ত অংশের যে জবরদস্তি মূলক উৎপাদন ঘটিয়ে থাকে, তার তুলনায় মজুরি শ্রমিকদের অবস্থার উপরে তা যে ধবংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা আমাদের ততটা আলোড়িত করে না। এই ব্যাপারে এমনকি বুর্জোয়া অর্থতাত্ত্বিকদের মধ্যে পর্যন্ত দ্বিমত নেই। এর উৎপাদনী উদ্দীপনা আরো উদ্দীপিত হয় সংরক্ষণ ব্যবস্থার দ্বারা যা এর একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জাতীয় ঋণ, এবং তার আনুষঙ্গিক রাজ-ব্যবস্থা, সম্পদের মূলধনীকরণে এবং জনসমষ্টির উচ্ছেদ-সাধনে যে বৃহৎ ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা থেকে কবেট, ডাবলডে প্রভৃতির মত অনেক লেখক এই ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে এটাই বুঝি আধুনিক জনসমাজগুলির দুর্দশার মৌল কারণ।
সংরক্ষণ-ব্যবস্থা ছিল ম্যানুফ্যাকচারে রত ম্যানুফ্যাকচারকারীদের হাতে একটা কৃত্রিম হাতিয়ার, যার সাহায্যে তারা স্বাধীন শ্রমিকদের উচ্ছেদ করত, উৎপাদন ও জীবনধারণের জাতীয় উপায়-উপকরণকে মূলধনীকৃত করত, মধ্যযুগীয় উৎপাদন-পদ্ধতি থেকে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতিতে অতিক্ৰমণকে সংক্ষেপিত করত। এই উদ্ভাবনের একাধিকার (পেটেন্ট নিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি পরস্পরকে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলত, এবং, একবার উদ্বৃত্ত-মূল্য তৈয়ারকারীদের সেবাকার্যে ভর্তি হয়ে যাবার পরে, এই অভীষ্ট অনুসরণে নিজেদের আপন আপন জনগণের কাছ থেকে পরোক্ষভাবে, সংরক্ষণ-শুল্কের মাধ্যমে এবং, প্রত্যক্ষ ভাবে, রপ্তানি-পরিপোষণের মাধ্যমে কেবল দক্ষিণা আদায়ই করত না, তার উপরে, তারা তাদের অধীনস্থ দেশগুলির সমস্ত শিল্পকে জোর করে নির্মূল করে দিত, যেমন ইংল্যাণ্ড করেছিল আইরিশ পশম শিল্পের ক্ষেত্রে। ইউরোপীয় ভূখণ্ডে, কোলবাট-এর দৃষ্টান্তের পরে, প্রক্রিয়াটা অনেক সরলীকৃত হল। আদিম শিল্প-মূলধন এখানে অংশত এসেছিল সরাসরি রাষ্ট্রীয় ধনাগার থেকে। মিরাবব