আদিবাসীদের প্রতি আচরণ স্বভাবতই সবচেয়ে সাংঘাতিক আতংকজনক ছিল ওয়েস্ট ইণ্ডিজের মত বাগিচা-উপনিবেশগুলিতে, যেগুলি নির্দিষ্ট ছিল কেবল রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য, এবং মেক্সিকো ও ভারতের মত ধন-সমৃদ্ধ ও জনবহুল দেশগুলিতে, যেগুলিকে পরিণত করা হয়েছিল লুণ্ঠন-ক্ষেত্রে। কিন্তু যেগুলিকে সঠিক ভাবেই উপনিবেশ (কলোনি’ ) বলা হয়, সেগুলিতেও আদিম সঞ্চয়নের খ্ৰীষ্টীয় চরিত্র নিজেকে মিথ্যা করেনি। ১৭০৩ সালে প্রোটেস্ট্যান্টবাদের সেই প্রাক্ত বিশেষজ্ঞ, বা নিউ ইংল্যাণ্ডের ‘পিউরিটানরা, তাদের সভার বিধান-বলে প্রত্যেকটি ভারতীয় খুলির উপরে এবং প্রত্যেকটি অধিকৃত লাল-চামড়ার উপরে ৪০ পাউণ্ড করে পুরষ্কার ধার্য করল; ১৭২০ সালে প্রত্যেক খুলির উপরে ১০০ পাউণ্ড; ১৭৭৪ সালে, ম্যাসাচুসেটস-বে একটি উপজাতিকে বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করার পরে, ধার্য হয়েছিল নিচের দামগুলি। ১২ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের একটি পুরুষের খুলি ১০০ পাউণ্ড (নোতুন টাকায়), একটি পুরুষ বন্দীর জন্য ১০৫ পাউণ্ড, নারী ও শিশু বন্দীদের জন্য ৫০ পাউণ্ড, নারী ও শিশুদের খুলির জন্য ৫০ পাউণ্ড। কয়েক দশক পরে, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার প্রতিহিংসা গ্রহণ করল ধর্মাচারী তীর্থপথিক পিতৃপুরুষদের উপরে, যারা ইতিমধ্যেই পরিণত হয়েছে দেশদ্রোহীতে। ইংরেজদের প্ররোচনায় এবং ইংরেজদের কাছ থেকে পেয়ে লোহিত চর্মরা তাদের হত্যা করল কুঠারাঘাতে। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সন্ধানী-কুকুর আর মুণ্ড শিকারকে ঘোষণা করল “তার হাতে ঈশ্বর ও প্রকৃতি-প্রদত্ত উপায় বলে।
চারা তৈরির গরম-ঘরের মত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্য ও নৌ-চলাচল ব্যবস্থাকে পরিণত করে তুলল। লুথারের একচেটিয়া সমিতিগুলি” (“সোসাইটিজ মনোপোলিয়া”) মূলধন কেন্দ্রীকরণের শক্তিশালী অনুপ্রেরক হিসাবে কাজ করল। নব-প্রস্ফুটিত শিল্পসমূহের জন্য উপনিবেশগুলি করে দিল বাজারের সংস্থান এবং বাজারের একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে গড়ে উঠল বর্ধিত সঞ্চয়ন। নিরাবরণ লুণ্ঠন, দাসত্ব-বন্ধন ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে দখলীকৃত ঐশ্বর্য পুনঃপ্রেরিত হত স্বদেশে এবং সেখানে পরিণত হত মূলধনে। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে সর্বাগ্রে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলেছিল হল্যাণ্ড; ১৬৪৮ সালেই সে পৌছে গিয়েছিল তার বাণিজ্যিক মহিমার শীর্ষদেশে। তখন তার প্রায় একান্ত অধিকারের মধ্যে এসে গিয়েছিল পূর্ব-ভারতীয় ব্যবসা এবং ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশের মধ্যেকার বাণিজ্য। তার মৎস্য-ক্ষেত্র, নৌবহর, শিল্পোৎপাদন অন্য যে-কোনো দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। উক্ত প্রজাতন্ত্রের মোট মূলধন সম্ভবত বাকি ইউরোপের সমস্ত মূলধনের মোট সমাবেশের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” গুলিচ একথা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছেন যে, ১৬৪৮ সালের মধ্যে হল্যাণ্ডের জনগণও বাকি ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তুলনায় ছিল মাত্রাতিরিক্ত কর্মভারে ও দারিদ্র্যে এবং পাশবিক অত্যাচারে অতিরিক্ত ক্লিষ্ট।
আজকাল শিল্পগত প্রাধান্য মানে হল বাণিজ্যগত প্রাধান্য। সঠিকভাবে অভিহিত ম্যানুফ্যাকচারের আমলে ব্যাপারটা ছিল আলাদা; তখন বাণিজ্যগত প্রাধান্যই দান করত শিল্পগত আধিপত্য। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা যে তখন প্রাধান্যপুর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করত, তার কারণও ছিল এই। নবাগত ঈশ্বর” তখন ইউরোপের পুরাগত ঈশ্বরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ দিয়ে বেদি-মঞ্চে আসন পরিগ্রহণ করেন। তার পরে একদিন আচমকা এক ধাক্কা ও লাথি মেরে তাদের সকলকে এক জঞ্জালপে ছুড়ে ফেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনই হল মানবজাতির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
‘পাব্লিক ক্রেষ্টি অর্থাৎ জাতীয় ঋণ, যার উৎপত্তি আমরা আবিষ্কার করি জেনোয়া ও ভেনিসে সেই মধ্য যুগেই, তা ইউরোপের উপরে অধিকার কায়েম করল সাধারণ ভাবে ম্যানুফ্যাকচার-আমলে। সামুদ্রিক বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক যুদ্ধ-বিগ্রহ সমেত ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা তার জন্য কাজ করল ‘বাধ্যতা-আয়োপের আগার হিসাবে। এই ভাবে তা প্রথম শিকড় গাড়ল হল্যাণ্ডে। জাতীয় ঋণ অর্থাৎ রাষ্ট্রের পরকীকরণ সে স্বৈরতান্ত্রিক, সাংবিধানিক বা প্রজাতান্ত্রিক, যা-ই হোক না কেন—তা ধনতান্ত্রিক যুগের উপরে একে দেয় নিজের মোহর। তথাকথিত জাতীয় সম্পদের একমাত্র যে অংশটি আধুনিক দেশের মোট জনসংখ্যার যৌথ অধিকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়, সেটি হল—জাতীয় ঋণ।[৭] এই জন্যেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে এল এই আধুনিক মতবাদ : যতই গভীর ভাবে একটি জাতি ঋণগ্রস্ত হয়, ততই সে হয় ধনবান। জাতীয় ঋণ পরিণত হয় মূলধনের ‘জপ-মন্ত্রে। এবং জাতীয় ঋণ-গঠনের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে, জাতীয় ঋণের প্রতি অবিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি অধর্মের স্থান গ্রহণ করে।
জাতীয় ঋণ পরিণত হয় আদিম সঞ্চয়নের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অনুপ্রেরকসমূহের মধ্যে অন্যতম অনুপ্রেরকে। যাদুকরের যাদু-দণ্ডের এক আঘাতের মত তা বন্ধ্যা অর্থকে প্রজননের ক্ষমতায় সমন্বিত করে এবং, শিল্পে, এমনকি, কুসীদ-বৃত্তিতে বিনিয়োজিত হবার সঙ্গে যে-ঝুকি ও ঝামেলা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকে সেই ঝুকি ও ঝামেলার মুখে নিজেকে উন্মুক্ত করার আবশ্যকতা ব্যতিরেকেই, তাকে মূলধনে পরিণত করে। রাষ্ট্রের ঋণ-দাতারা (স্টেট-ক্রেডিটরস’) আসলে কিছুই দিয়ে দেয় না, কারণ যে-অর্থ ধার দেওয়া হয় তা রূপান্তরিত হয় জাতীয় বণ্ডে, যা সহজেই ভাঙানো যায় এবং যা তাদের হাতে কাজ করতে থাকে সেই পরিমাণ নগদ টাকার মত। উপরন্তু, এই ভাবে সৃষ্ট অলস অ্যানুইটি’-ভোগীদের একটি শ্রেণী ছাড়াও সরকার ও জাতির মধ্যে মধ্যস্থতা কারী অর্থ-সংস্থানকারীদের (ফিনান্সিয়ার’-দের) উপস্থিতমত তৈরি সম্পদ ছাড়াও, এবং সেই সঙ্গে কর-আদায়ের ইজারাদার (ট্যাক্স-ফার্মার’ ), সওদাগর, ব্যক্তিগত ম্যানুফ্যাকচারার যাদের কাছে প্রত্যেকটি জাতীয় ঋণের একটা বড় অংশ আকাশ থেকে পড়া মূলধনের মত কাজ করে, তাদের ছাড়াও জাতীয় ঋণ উদ্ভব ঘটিয়েছে যৌথমূলধন কোম্পানি, সর্বপ্রকার বিনিময় সম্পত্তির লেনদেনের এবং বাটা-দান ব্যবস্থার-এক কথায় স্টক-এক্সচেঞ্জের জুয়াড়ি-বৃত্তির এবং আধুনিক ব্যাংক-তন্ত্রের।