আমেরিকায় সোনা রুপার আবিষ্কার; আদিবাসী জনসংখ্যার উৎপাটন, ক্রীতদাসে রূপান্তরণ ও খনিগর্ভে সমাধিস্থকরণ; ইস্ট ইণ্ডিজ-এর জয় ও লুণ্ঠনের উদ্বোধন; কৃষ্ণচর্মদের বাণিজ্যিক শিকারের জন্য আফ্রিকাকে মৃগয়া-ভূমিতে পরিবর্তন এই ঘটনাবলী সূচিত করল ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-যুগের রঙীন প্রভাতের আবির্ভাব। এই সরল-সুন্দর ক্রিয়াকলাপগুলিই হল আদিম সঞ্চয়নের প্রধান অনুপ্রেরক। এই সব তৎপরতার পায়ে-পায়ে এল ইউরোপীয় জাতিগুলির বাণিজ্যিক যুদ্ধ-বিগ্রহ—গোটা ভূমণ্ডলই হল রণক্ষেত্র। এর সূচনা হয় স্পেনের বিরুদ্ধে নেদারল্যাণ্ডের বিদ্রোহে, আয়তন-বৃদ্ধি হয় ইংল্যাণ্ডের জ্যাকোবিন-বিরোধী যুদ্ধে এবং আজও পর্যন্ত পরিব্যাপ্তি ঘটে চীনের বিরুদ্ধে অহিফেন যুদ্ধ ইত্যাদিতে।
আদিম সঞ্চয়নের বিভিন্ন অনুপ্রেরকগুলি এখন নিজেদেরকে মোটামুটি কালক্ৰম হিসাবে ভাগ করে দেয়, বিশেষ করে, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ডের মধ্যে। ইংল্যাণ্ডে সতের শতকের শেষে সেই অনুপ্রেরকগুলি উপনীত হয় একটি সুবিন্যস্ত সন্নিবেশে—যার মধ্যে বিধৃত হয় উপনিবেশসমূহ, জাতীয় ঋণ, আধুনিক কর প্রণালী এবং সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা। এই সমস্ত পদ্ধতি অংশত নির্ভর করে পশু-শক্তির উপরে অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার উপরে। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতিকে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতিতে পরিণত করার জন্য, অতিক্রমণের সময়কাল সংক্ষিপ্ত করার জন্য, গরম-ঘরে চারা তৈরীর কায়দায়, তারা সকলেই ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা, সমাজের কেন্দ্রীভূত ও সংগঠিত শক্তি। নোতুন সমাজ-সন্ত্রায় গর্ভবতী প্রত্যেক পুরনো সমাজের ধাত্রী হল শক্তি। এটা নিজেই হল একটা অর্থ নৈতিক ক্ষমতা।
খ্রীষ্টীয় ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ভব. হাউইট, যিনি নিজে খ্রীষ্টধর্ম সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “বিশ্বের প্রত্যেকটি অঞ্চল জুড়ে এবং যে-সমস্ত জাতিকে সে পদানত করতে পেরেছে তাদের প্রত্যেকটি জাতির উপরে তথাকথিত খ্ৰীষ্টীয় জাতি যেসব বর্বরতা ও বেপরোয়া অত্যাচার চালিয়েছে তার সঙ্গে, পৃথিবীর কোনো যুগে আর কোনো জাতির—তা সে যত ভয়ংকর, যত অ-সংস্কৃত, যত নির্ণয় ও নির্লজ্জই হোক না কেন, তার বর্বরতা ও অত্যাচারের তুলনা মেলেনা।”[৪] হল্যাণ্ডের ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস এবং হল্যাণ্ড ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শীর্ষস্থানীয় ধনতান্ত্রিক জাতি-সেই জাতির ঔপনিবেশিক প্রশাসনের ইতিহাস হল “বেইমানি, ঘুষখোরি, গণহত্যা ও নীচতার এক নজীরবিহীন ইতিবৃত্ত।”[৫] জাভার জন্য গোলাম করার মতলবে মানুষ চুরি করার ব্যবস্থার চেয়ে আর কিছুই তাদের চরিত্রের এমন বৈশিষ্ট্যসূচক নয়। এই ব্যবসায়ে প্রধান দালাল ছিল চোর, দোভাষী ও বিক্রেতা; প্রধান বিক্রেতা ছিল দেশীয় রাজারা। চুরি-করা তরুণদের নিক্ষেপ করা হত সেলিবিসের অন্ধকূপগুলিতে, যে পর্যন্ত না তৈরি হত দাস-জাহাজগুলিতে রপ্তানির জন্য। একটি সরকারি রিপোর্ট বলা হয়, “নমুনা হিসাবে ম্যাকাসার নামক এই একটি শহরের কথাই বলা যাক। এটা কারাগারে আর কারাগারে ভর্তি; একটার চেয়ে আরেকটা বেশি ভয়ংকর; পরিবার-পরিজন থেকে ছিন্ন করে নিয়ে আসা, লোভ ও অত্যাচারের শিকার, শৃংখলবদ্ধ হতভাগ্যদের দ্বারা জনাকীর্ণ।” মালাক্কাকে হাত করার জন্য ওলন্দাজরা পতুগীজ শাসনকর্তাকে ঘুষ দিল। ১৬৪১ সালে সে তাদের শহরের মধ্যে ঢুকতে দিল। তারা সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে ছুটে গেল এবং তাকে হত্যা করল যাতে করে তার দেশদ্রোহিতার মূল্য স্বরূপ তাকে ২১,৮৭৫ পাউণ্ড দেওয়া থেকে নিজেদের সংবরণ করা যায়। যেখানেই তারা পদার্পণ করল, সেখানেই ঘটল ধ্বংস ও জনশূন্যতা। জাভার একটি প্রদেশ; নাম বাজুওয়াংগি; ১৭৫০ সালে অধিবাসী-সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ হাজার; ১৮১১ সালে তা দাঁড়াল ১৮,০০০। কী মধুর বাণিজ্য।
যে-কথা সুপরিজ্ঞাত, ইংরেজ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী’ ভারতে রাজনৈতিক শাসন ছাড়াও লাভ করে চা-ব্যবসায়ের, এবং সেই সঙ্গে সাধারণ ভাবে চীনা-ব্যবসায়ের ও ইউরোপের সঙ্গে মাল আদান-প্রদান পরিবহনের একচেটিয়া অধিকার। কিন্তু ভারতের উপকূলবর্তী এবং সেই সঙ্গে অন্তদ্বীপ ও অন্তর্দেশীয় ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার ছিল কোম্পানীর উর্ধতন কর্মচারীদের। লবণ, পান ও অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর একচেটিয়া অধিকার ছিল ঐশ্বর্যের অফুরান খনি। কর্মচারীরা নিজেরাই দাম ধার্য করত এবং দুর্ভাগা হিন্দুদের খুশিমত লুণ্ঠন করত। এই বেসরকারি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বয়ং বড়লাট (গভর্নর-জেনারেল) অংশ গ্রহণ করত। তার প্রিয়পাত্ররা এমন শর্তে ঠিকা (কন্টাক্ট ) পেত যে অ্যালকেমিস্টদের চেয়েও চতুর এই লোকগুলি শূন্য থেকে সোনা তৈরি করত। একদিনের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠত বিরাট বিরাট ঐশ্বর্য; এক শিলিংও আগাম না দিয়ে আদিম সঞ্চয়ন চলতে থাকল অবাধে। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিচাৰু এই রকমের হাজার হাজার ঘটনায় গিজগিজ করছে। একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। জনৈক সুলিভান যখন এক সরকারি কাজে আফিম অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ভারতের এক অংশের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল, তখন তাকে দেওয়া হল একটি আফিমের ঠিকা। সুলিভান সেই ঠিকাটা বেচে দিল ৪০,০০০ পাউণ্ডের বিনিময়ে জনৈক বিন-এর কাছে। ঐ দিনই বিন সেটাকে বেচে দিল ৬০,০০০। পাউণ্ডে, এবং শেষ পর্যন্ত যে-ক্রেতাটি ঠিকাটি পূরণ করল, সে জানাল যে সেবিপুল পরিমাণ মুনাফা কামিয়েছে। পার্লামেন্টের সমক্ষে উপস্থাপিত একটি তালিকা থেকে দেখা যায়, ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৬ পর্যন্ত কোম্পানী আর তার কর্মচারীরা ভারতীয়দের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিল ৬০,০০,০০০ পাউণ্ড। ১৭৬৯ এবং ১৭৭০ সালের মধ্যে ইংরেজরা সেখানে সমস্ত চাল কিনে নিয়ে এবং অবিশ্বাস্য চড়া দাম ছাড়া তা বিক্রি করতে অস্বীকার করে উৎপাদন করল একটা দুর্ভিক্ষ। [৬]