৬. ক্রমওয়েল-এর আমল একটা ব্যতিক্রম। যতদিন প্রজাতন্ত্র টিকে ছিল, ততদিন সমস্ত স্তরের ইংরেজ জনগণ টিউডরদের অধীনে তারা যে অধঃপতনে তলিয়ে গিয়েছিল, তা থেকে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল।
৭. টাকেট এ ব্যাপারে অবহিত যে, আধুনিক উল শিল্পের উন্মেষ ঘটেছে মেশিনারি প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত ম্যানুফ্যাকচার থেকে—এবং গ্রামীণ ও ঘবোয়া শিল্পগুলির ধ্বংসপ্রাপ্ত থেকে। লাঙল এবং জোয়াল হল দেবতাদের উদ্ভাবন এবং বীরদের বৃত্তি; তাঁত, টাকু, কাটিমের বংশপরিচয় অতটা উচু নয়। আপনি কাটিম আর লাঙল, মাকু আর জোয়ালকে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তা হলে পাবেন কারখানা, আর দুঃস্থ-নিবাস, ক্রেডিট আর আতঙ্ক, দুটি শত্রুভাবাপন্ন জাতি—একটি কৃষিজীবী, অন্যটি বাণিজ্য-জীবী।” (ডেভিড আহার্ট, ঐ পৃ ১২২)। কিন্তু এখন ক্যারি এলেন, এবং ধিক্কার জানালেন ইংল্যাগুকে, অবশ্য অযৌক্তিক ভাবে নয়, যে সে চেষ্টা করছে বাকি প্রত্যেকটি দেশকে কেবল কৃষিজীবী দেশে পরিণত করতে, যার শিল্লোৎপাদক হবে ইংল্যান্ড। তিনি দাবি করেন, এই ভাবেই ধ্বংস হয়েছে তুরস্ক, কেননা ইংল্যাণ্ড তার অধিকারী ও অধিবাসীদের কখনো সুযোগ দেয়নি লাঙল ও অঁতের মধ্যে, হাতুড়ি ও মইয়ের মধ্যে স্বাভাবিক মৈত্রীর প্রতিষ্ঠা করে নিজেদেরকে শক্তিশালী করতে।’ (দি স্লেভ ট্রেড, পৃঃ ১২৫। তাঁর মতে, আকু হার্ট নিজেই হচ্ছেন তুরস্কের ধ্বংস-সাধনের প্রধান প্রযোজক, যেখানে তিনি ইংল্যাণ্ডের স্বার্থে পরিচালনা করেছেন অবাধ বাণিজ্যের প্রচারকার্য। সবচেয়ে সেরা ব্যাপার এই যে, ক্যারি, যিনি প্রসঙ্গত একজন রুশ-প্রেমিক, উল্লিখিত বিচ্ছেদের প্রক্রিয়াটিকে নিবারণ করতে চান ঠিক সেই সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার সাহায্যে, যা তাকে ত্বরান্বিত করে।
৮. মিল, রজার্স, গোল্ডইন স্মিথ, ফসেট প্রমুখ মানবহিতৈষী এবং জন ব্রাইট অ্যাণ্ড কোম্পানির মত উদারনৈতিক ম্যানুফ্যাকচারকারীরা ইংরেজ ভূমি-মালিকদের জিজ্ঞাসা করছেন, যেমন ভগবান জিজ্ঞাসা করেছিলেন অ্যাবেল-এর পরে কেইনকে, ‘আমাদের সেই হাজার হাজার স্বাধীন স্বত্বভোগীরা কোথায় গেল? তারপর, তোমরাই বা কোথা থেকে এলে? এল ঐ স্বাধীন স্বত্বভোগীদের ধ্বংস করে দিয়ে। কেন আপনি আরো জিজ্ঞাসা করেন না, কোথায় গেল সেই স্বাধীন তাঁতীরা, সুতো কাটুনিরা এক কুটিরশিল্পীরা?
৩১. শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
একত্রিশ অধ্যায়– শিল্প-ধনিকের উৎপত্তি
কৃষি-মালিকের উৎপত্তির মত শিল্প-ধনিকের[১] উৎপত্তি এমন ক্রমিক ভাবে হয়নি। সন্দেহ নেই যে, অনেক ছোট গিলভ-মাস্টার, এবং তার চেয়েও বেশিসংখ্যক স্বাধীন ঘোট কারিগর, কিংবা এমনকি মজুরি-শ্রমিকেরাও নিজেদের রূপান্তরিত করেছিল ঘোট ছোট ধনিকে এবং (ক্রমে ক্রমে মজুরিশ্রমের শোষণ ও তৎসহ সঞ্চয়নের বিস্তার সাধন করে) পুরোদস্তুর ধনিকে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের শৈশবে, ঘটনাবলী এমনভাবে ঘটত যেমন ভাবে সেগুলি ঘটত মধ্য যুগে, যেখানে, কোন্ পলাতক ভূমিদাস হবে মনিব আর কোন্ জন হবে দাস, সে প্রশ্ন বহুলাংশে নির্ধারিত হত তাদের মধ্যে কে আগে পালিয়েছে আর কে পরে পালিয়েছে, সেই তারিখের দ্বারা। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষ দিককার বিরাট বিরাট আবিষ্কারগুলি যেসব বাণিজ্যিক প্রয়োজন সৃষ্টি করল, তা এই পদ্ধতির শম্বক গতির সঙ্গে কোনরকমেই সঙ্গতি রাখল না। কিন্তু, মধ্যযুগ দিয়ে গিয়েছিল দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মূলধন, যা পরিণতি লাভ করে অত্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অর্থ নৈতিক সমাজ-সংগঠনে এবং যা, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির পূর্বে, বিবেচিত হয় মূলধনের ‘quand meme’ হিসাবে-কুসীদজীবীর মূলধন এবং বণিকের মূলধন হিসাবে।
“বর্তমান সমাজের সমস্ত সম্পদ প্রথম যায় ধনিকের অধিকারে সে জমির মালিককে দেয় তার খাজনা, শ্রমিককে তার মজুরি, কর ও শুল্ক সংগ্রাহকদের তাদের পাঙ্গা এবং নিজের জন্য রাখে শ্রমের বার্ষিক উৎপন্নের একটি বৃহৎ অংশ, বস্তুতঃ পক্ষে বৃহত্তম ও নিরন্তর বর্ধমান অংশ। ধনিককে এখন বলা যেতে পারে সমাজের সমস্ত সম্পদের প্রথম মালিক, যদিও কোনো আইন তাকে দেয়নি এই সম্পত্তির উপরে তার অধিকার এই পরিবর্তনটা ঘটানো হয়েছে মূলধনের উপরে সুদ আদায় করার মাধ্যমে এবং এটা মোটেই কৌতুহলকর নয় যে ইউরোপের সমস্ত আইনপ্রণেতারা চেষ্টা করেছিলেন আইনের সাহায্যে একে বাধা দিতে—কুসীদবৃত্তির বিরুদ্ধে আইনের সাহায্যে দেশের সমস্ত সম্পদের উপরে বনিকের ক্ষমতা সম্পত্তির অধিকারে ঘটিয়ে দিল সম্পূর্ণ পরিবর্তন; এবং কোন আইনের দ্বারা বা আইনসমূহের দ্বারা এই পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল?”[২] লেখকের মনে রাখা উচিত ছিল, বিপ্লব আইনের দ্বারা সাধিত হয় না।
কুসীদবৃত্তি ও বাণিজ্যের দ্বারা যে অর্থ মূলধন গঠিত হল, তা শিল্প-মূলধনে রূপান্তরিত হতে পারেনি; গ্রামাঞ্চলে তাকে বাধা দিল সামন্ততান্ত্রিক সংবিধান এবং শহরাঞ্চলে তাকে বাধা দিল গিলড-সংগঠন।[৩] সামন্ততন্ত্রের অবসানের ফলে গ্রামীণ জনসংখ্যার অধিকার-হরণ ও আংশিক উচ্ছেদসাধনের সঙ্গে এই শৃংখলগুলিরও অবলুপ্তি ঘটল। নোতুন ম্যানুফ্যাকচারগুলি প্রতিষ্ঠিত হল সাগর বন্দর কিংবা অন্তর্দেশীয় সেই সব জায়গায়, যেগুলি পুরনো পৌরসংস্থা ও তার গিলসমূহের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সুতরাং, ইংল্যাণ্ডে চলল এই নোতুন শিল্প-লালনকেন্দ্রগুলির বিরুদ্ধে যৌথ শহরগুলির তীব্র সংগ্রাম।