বস্তুতঃ পক্ষে, যে-ঘটনাবলী ছোট চাষীকে রূপান্তৰিত করল মজুরি-শ্রমিকে এবং তাদের জীবনধারণের উপকরণাদিকে রূপান্তরিত করল মূলধনের বস্তুগত উপাদানে, তা যুগপৎ মূলধনের জন্য একটি অভ্যন্তরীণ বাজারও সৃষ্টি করল। আগে, চাষী-পরিবার জীবন-ধারণের উপকরণ ও কাঁচামাল উৎপাদন করত যার বেশির ভাগটা তারা নিজেরাই পরিভোগ করত। এই কাঁচামাল ও জীবনধারণের উপকরণ সমূহই এখন পরিণত হয়েছে পণ্যদ্রব্যে, বৃহৎ কৃষি-মালিক সেগুলিকে বিক্রি করে, কর্মশালাগুলিতে সে পায় তার বাজার। সুতো, শণের কাপড়, পশমের আটপৌরে জিনিসপত্র—যেসব দ্রব্যসামগ্রী আগে ছিল প্রত্যেক চাষী-পরিবারের নাগালের মধ্যে, যেগুলি আগে সে নিজেই বুনত তার নিজের ব্যবহারের জন্য—সেগুলি রূপান্তরিত হল ম্যানুফ্যাকচারের দ্রব্যসামগ্রীতে, যেগুলি সঙ্গে সঙ্গে মফস্বলের জেলাগুলিতে পেয়ে গেল তৈরি বাজার। বিক্ষিপ্ত কারিগরেরা এতাবৎকাল আপন-আপন মনে কর্মরত অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের মধ্যে যে-ইতস্ততঃ অবস্থিত ক্রেতাদের পেত, এখন সেই উৎপাদন কারীরা কেন্দ্রীভূত হয় শিল্প-মূলধনের দ্বারা সৃষ্ট একটি বিশাল বাজারে।[৫] এইভাবে স্বাবলম্বী চাষীদের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে, নিজেদের উৎপাদনের উপায়-উপকরণ থেকে বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে একযোগে সংঘটিত হয় গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্প, ম্যানুফ্যাকচার এবং কৃষিকর্মের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদের প্রক্রিয়া। এবং গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের সর্বনাশই কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘটাতে পারে সেই সম্প্রসারণ, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন পদ্ধতির পক্ষে যা একান্ত প্রয়োজন। তবু যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার-আমল বলা যায়, সেই আমল সফল হয়নি এই রূপান্তরকে আমূল ভাবে ও সম্পূর্ণ ভাবে সম্পাদন
শিল্পের উপরে কৃষি-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া করতে। স্মরণীয় যে, যথাযথ ভাবে যাকে ম্যানুফ্যাকচার বলা যায়, তা জাতীয় উৎপাদনের কেবল একটি অংশকেই জয় করে এবং, নিজের শেষ ভিত্তি হিসাবে সর্বদাই নির্ভর করে শহরের হস্তশিল্প এবং গ্রামাঞ্চলের ঘরোয়া শিল্পগুলির উপরে। যদি বিশেষ বিশেষ শাখায় কোন কোন ক্ষেত্রে তা সেগুলিকে ধ্বংস করে এক আকারে, তা হলে অন্যত্র তা সেগুলির উদ্ভব ঘটায় অন্য আকারে, কারণ একটা পর্যায় পর্যন্ত তার সেগুলিকে লাগে কাঁচামাল প্রস্তুতির জন্য। সুতরাং, তা ছোট গ্রামবাসীদের নোতুন এক শ্রেণী গড়ে তোলে, যার সহায়ক বৃত্তি হিসাবে চাষের কাজ করলেও, তাদের প্রধান বৃত্তি খুজে পায় শিল্প-শ্রমের মধ্যে, যার উৎপাদিত দ্রব্যসম্ভার তারা ম্যানুফ্যাকচারকারীদের কাছে বিক্রি করে হয়, সরাসরি আর নয়তো বণিকদের মাধ্যমে। ইংরেজ ইতিহাসের ছাত্রকে ধাঁধায় ফেলে দেয়, এট। তেমনি একটা ঘটনার অন্যতম কারণ, যদিও প্রধান কারণ নয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর তৃতীয় ভাগ থেকে মফস্বলের অঞ্চলগুলিতে ধনতান্ত্রিক কৃষিকর্মের অনধিকার প্রবেশ এবং চাষী-সম্প্রদায়ের উত্তরোত্তর ধ্বংসসাধন সম্পর্কে অভিযোগ ক্রমাগত তার নজরে আসে—তাতে ছেদ পড়ে কেবল মাঝে মাঝে। অন্য দিকে সে এই চাষী সম্প্রদায়কে দেখে পুনর্বার উপস্থিত হতে, যদিও অল্পতর সংখ্যায় এবং আরো খারাপ অবস্থায়।[৬] প্রধান কারণ এই : ইংল্যাণ্ডে, পর্যায়ক্রমে, এক সময়ে প্রধানতঃ শস্য-কৰ্ষক এবং অন্য সময়ে প্রধানতঃ গবাদি পশু-পালক; এবং এই দুই পর্যায় অনুযায়ী চাষীর চাষের পরিধিরও ঘটে বৃদ্ধি বা হ্রাস। আধুনিক শিল্পই একক ভাবে এবং চূড়ান্তভাবে মেশিনারির আকারে সরবরাহ করে ধনতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থার চিরস্থায়ী ভিত্তি, সমূলে উৎপাটিত করে সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষি জনসমষ্টি এবং সুসম্পূর্ণ করে কৃষি ও গ্রামীণ ঘরোয়া শিল্পের মধ্যে বিচ্ছেদ, যার শিকড়কে—সুতো কাটা ও কাপড় বোনাকে—তা ছিন্নভিন্ন করে দেয়।[৭] এই ভাবে তা, প্রথমবারের মত, সমগ্র অভ্যন্তরীণ বাজারকে জয় করে দেয় শিল্পমূলধনের জন্য।[৮]
————
১. তাঁর “নোশনস দ্য ফিলসফি ন্যাচুরেল”-এ, প্যারিস, ১৮৩৮।
২. একটি পয়েন্ট’ যার উপরে জেম্স স্টুয়ার্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।
৩. “Je permettrai” xf2 269,”que vous ayez l’honneur de me servir, a condition que vous me donnez le peu qui vous reste pour la peine que je prends de vous commander.” (J. J, Rousseau : *Discours sur l’Ecouomie Politique.’ )
৪. মিরাবো মনে করেন বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলি সংযোজিত কর্মশালাগুলি থেকে বেশি মিতব্যয়ী এবং উৎপাদনশীল এবং সংযোজিত কর্মশালাগুলির মধ্যে দেখতে পান সরকারি কৃষির অধীনে কেবল কৃত্রিম বিদেশিয়ানা; ইউরোপীয় ভূখণ্ডের ম্যানুফ্যাকচার গুলির একটা বড় অংশের তখন যা অবস্থা ছিল, তা থেকেই মিরাববার এই ধারণার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
৫. অন্য কাজের অবকাশে ২০ পাউণ্ড উলকে অনায়াসে নিজেদের শ্রমের সাহায্যে একটি শ্রমিকের পরিবারের বাৎসরিক পরিচ্ছদে রূপান্তরণ-তাতে কোনো দর্শনীয় ব্যাপার হয় না; কিন্তু সেটা বাজারে আন, কারখানায় পাঠান, সেখান থেকে দালালকে, তারপরে কারবারকে এবং আপনি প্রত্যক্ষ করবেন বড় বড় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, এবং তার মূল্যের ২০ গুণ পরিমাণ আর্থিক মূলধনের বিনিয়োগ। এই ভাবে শ্রমিক শ্রেণী বাধ্য হয় এক লক্ষ্মীছাড়া কারখানা-জনসংখ্যাকে পোষণ করতে–একটা পরগাছা দোকানদার শ্রেণী এবং একটা অলীক বাণিজ্যিক, আর্থিক ও মুদ্রাগত ব্যবস্থা। ডেভিড আকুহ, ঐ, পৃ ১২।