শিল্পমূলধনের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের সৃষ্টি
আমরা আগেই দেখেছি যে, কৃষি-জনসংখ্যার উচ্ছেদ ও বহিষ্কারের প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে বিরতি ঘটলেও, তা আবার বারে বারে নোতুন করে শুরু হত, এবং শহরের শিল্প গুলিতে যোগাত এমন সর্বহারা জনসমষ্টি, যা ছিল যৌথ গিন্ডগুলির সঙ্গে সংযোগ-শূন্য এবং তাদের শৃংখল থেকে মুক্ত; এটা এমনি একটা অনুকূল ঘটনা যে, বৃদ্ধ এ এণ্ডারসন ( জেমস এণ্ডারসনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে ভুল হবে) তাঁর “বাণিজ্যের ইতিহাস” নামক গ্রন্থে এমন একটা বিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, যেন এটা বিধাতার এক প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের ফলস্বরূপ। আমরা কিন্তু তবু আদিম সঞ্চয়নের এই উপাদানটি বিবেচনার জন্য এখানে একটু দাড়াব। স্বাধীন ও স্বাবলম্বী চাষীদের এই পাতলা হয়ে যাবার ফলে শিল্প সর্বহারাদের ঘটল সংখ্যাবৃদ্ধি ও ঘন-সন্নিবদ্ধ সমাবেশ—যেভাবে জিওফ্র সেন্ট হিলেয়ার এক জায়গায় মহাজাগতিক বস্তুর কেন্দ্রীভবনের ব্যাখ্যা করেছেন অন্য জায়গায় তার ভবনের সাহায্যে, ঠিক সেই ভাবে।[১] কৰ্ষকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, জমি আগেও যে ফসল দিত, এখনো সেই পরিমাণ বা তার বেশি ফসল দেয়; তার কারণ এই যে ভূ-সম্পত্তির অবস্থাবলীতে বিপ্লবের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল কৰ্ষণ-পদ্ধতির উন্নয়ন, সহযোগের সম্প্রসারণ, উৎপাদনের উপায়সমূহের কেন্দ্রীভবন ইত্যাদি। তার কারণ এই যে, কৃষিক্ষেত্রের মজুরি-শ্রমিকদের উপরে কেবল নিবিড়তর চাপ সৃষ্টিই করা হয়নি,[২] তার উপরে, যে-উৎপাদনের জমিতে তারা নিজেদের জন্য কাজ করত, সেই জমি আরো আরো সংকুচিত করা হয়েছিল। সুতরাং, কৃষি-জনসংখ্যার একটি অংশকে মুক্তি দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাদের পুষ্টি লাভের পূর্বতন উপায়গুলিকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেগুলি তখন রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের বাস্তব উপাদানে। জমি থেকে উচ্ছিন্ন ও উৎক্ষিপ্ত চাষীকে এখন ক্রয় করতে হবে মজুরির আকারে তাদের মূল্য—তার নোতুন মনিবের তথা শিল্প-ধনিকের কাছ থেকে। জীবনধারণের উপায়ের ক্ষেত্রে যা সত্য, স্বদেশের কৃষির উপরে নির্ভরশীল শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রেও তা সত্য। সেগুলিও রূপান্তরিত হল অস্থির মূলধনের একটি উপাদানে। দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, ওয়েস্ট ফ্যালিয়ার চাষীদের একটা অংশ, যারা দ্বিতীয় ফ্রেডরিক-এর আমলে সকলেই শণ বুনত, জমি থেকে সবলে উৎখাত ও বিতাড়িত হল; এবং বাকি যে-অংশ থেকে গেল, তারা পরিবর্তিত হল বড় বড় কৃষি-মালিকের দিনমজুরে। সেই একই সময়ে উদ্ভূত হল শণ কাটা ও বোনার বড় বড় প্রতিষ্ঠান, যেগুলিতে সম্প্রতি “মুক্তি-প্রদত্ত মানুষগুলি মজুরির জন্য কাজ করে। শণ আগেও যেমন দেখাত, এখনো ঠিক তেমনি দেখায়। তার একটা তন্তুরও কোন বদল ঘটেনি, কিন্তু তার দেহের মধ্যে এক নোতুন সামাজিক আত্মা ঢুকে পড়েছে। এখন তা রচনা করে ম্যানুফ্যাকচারকারী মালিকের স্থির মূলধনের একটা অংশ। অতীতে যা বিভক্ত ছিল বহুসংখ্যক ছোট ছোট উৎপাদনকারীর মধ্যে, যারা নিজেরাই যা চাষ করত এবং তাদের পরিবারবর্গের সাহায্যে খুচরো কায়দায় বয়ন করত, এখন তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে একজন মাত্র ধনিকের হাতে, যে অন্যান্যদের নিযুক্ত করে তার জন্য তা বয়ন করতে। শণ-বয়নে ব্যয়িত অতিরিক্ত শ্রম পূর্বে নিজেকে রূপায়িত করত অসংখ্য চাষী-পরিবারের অতিরিক্ত আয়ে কিংবা, হতে পারে, দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের আমলে, ট্যাক্সের আকারে-taxes pour le roi de Prusse। এখন তা নিজেকে রূপায়িত করে কয়েকজন ধনিকের জন্য মুনাফায়। টাকু এবং তঁত, যেগুলি আগে ছড়িয়ে ছিল সারা দেশ জুড়ে, এখন সেগুলি জমায়েৎ করা হয়েছে, শ্রমিক এবং কাঁচামাল সমেত, কয়েকটি বড় বড় শ্রমিক-ব্যারাকে। আর টাকু, তাঁত, কাচামাল এখন রূপান্তরিত হয়েছে কাটুনী ও তাঁতীদের স্বাধীন অস্তিত্বের উপায় থেকে তাদের উপরে কর্তৃত্ব চালাবার এবং তাদের থেকে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম চুষে নেবার উপায়ে।[৩] বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরি (শ্রম-কারখানা) ও খামার (ফার্ম)-এর দিকে তাকিয়ে কেউ বুঝতে পারে না যে, সেগুলির উৎপত্তি ঘটেছে অনেকগুলি ঘোট ঘোট উৎপাদন কেন্দ্রকে একটিমাত্র কেন্দ্রে পর্যবসিত করে এবং গড়ে তোলা হয়েছে অনেক ঘোট ঘোট স্বাধীন উৎপাদনকারীকে উৎখাত করে। যাই হোক, জনসাধারণের স্বাভাবিক বোধশক্তি কিন্তু ভুল করেনি। বিপ্লবের সিংহ-পুরুষ মিরাবোর সময়ে, বড় বড় ম্যানুফ্যাক্টরিগুলিকে তখনো বলা হত ‘ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস (manufactures reunies’), অনেকগুলি কর্মশালা একটা মাত্রে পর্যবসিত, যেমন আমরা বলি, অনেকগুলি তে একটামাত্ৰ ক্ষেত্রে পর্যবসিত। মিরাবো বলেন, “আমরা কেবল বিরাট ম্যানুফ্যাক্টরিগুলির দিকেই নজর দিচ্ছি, যেগুলিতে শত শত লোক কাজ করে একজন পরিচালকের অধীনে এবং। যেগুলিকে সাধারণত বলা হয় ম্যানুফ্যাকচার্স রিইউনিস। যেগুলিতে একটি বৃহৎ সংখ্যক শ্রমিক কাজ করে, প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা ভাবে এবং স্বতন্ত্র ভাবে, সেগুলির কথা খুব কমই বিবেচনা করা হয়; সেগুলিকে অন্যগুলির তুলনায় স্থাপন করা হয় সীমাহীন দূরত্বে। এটা একটা বিরাট ভুল, কেননা এগুলিই জাতীয় সমৃদ্ধির সত্য সত্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিরাট কর্মশালাটি (ম্যানুফ্যাকচার রিইউনিস’ বিপুলভাবে বিত্তশালী করে তুলবে দু-একজন শিল্পোদ্যোক্তাকে, কিন্তু শ্রমিকেরা থেকে যাবে কম বেশি মজুরি পাওয়া সেই দিন মজুর; প্রতিষ্ঠানের সাফল্যে তাদের থাকবে না কোনো অংশ। উলটো দিকে, ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালায় ম্যানুফ্যাকচার সেপারী) কেউই বিত্তশালী হবে না, কিন্তু বহুসংখ্যক শ্রমিক হবে সচ্ছল; যারা সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী, তারা সামান্য মূলধন জমাতে সক্ষম হবেনোতুন কোন শিশু-জন্মের জন্য কিংবা নিজেদের বা পরিবারবর্গের অসুখ-বিসুখের জন্য কিছু সরিয়ে রাখতে। সঞ্চয়ী ও পরিশ্রমী শ্রমিকদের। সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, কারণ তারা সদাচার ও কর্মনিষ্ঠার মধ্যে দেখতে পাবে তাদের অবস্থার যথার্থ উন্নতি সাধনের উপায়-সামান্য মজুরি-বৃদ্ধির মত যা তাদের ভবিষ্যতের পক্ষে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ হবে না, এবং যার একমাত্র ফল হবে তাদের দৈনন্দিন জীবনকে কিছুটা উন্নত করা, তা নয়।’: বিরাট কর্মশালাগুলি-কয়েকজন ব্যক্তিগত মালিকের প্রতিষ্ঠান, যেগুলি তাদের নিজস্ব লাভের জন্য শ্রমিকদের খাটিয়ে নিয়ে তাদের দৈনন্দিন মজুরি দিয়ে থাকে—সেগুলি এই ব্যক্তিগত মালিকদের স্বাচ্ছন্দ্য ঘটাতে পারে, কিন্তু সেগুলি কখনো সরকারের মনোযোগ আকর্ষণের মত যোগ্য হবে না। ক্ষুদ্রাকার বিচ্ছিন্ন কর্মশালাগুলিই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেগুলি কৃষি-কর্মের সঙ্গে সংযোজিত থাকে; সেগুলিই হল কেবল স্বাধীন কর্মশালা।[৪] কৃষি-জনসংখ্যার একটা অংশের উচ্ছেদ ও উৎপাদন শিল্পমূলধনের জন্য কেবল শ্রমিকদেরকে, তাদের জীন-ধারণের উপকরণাদিকে এবং শ্রমের সামঞ্জসভারকেই মুক্ত করে দিল না, তা সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারেরও সৃষ্টি করল।