তা হলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন দ্রব্যের মূল্যের আয়তন যা দিয়ে নির্ধারিত হয়, তা হচ্ছে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের পরিমাণ, অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়(৯)। এই সূত্রে, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পণ্যকে ধরতে হবে তার সমশ্রেণীর পণ্যের একটি গড় নমুনা হিসেবে।(১০) সুতরাং যে সমস্ত পণ্যে একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে অথবা যা একই সময়ের মধ্যে উৎপন্ন করা যায় সেগুলির মূল্য একই। এক পণ্যের মূল্যের সঙ্গে আর এক পণ্যের মূল্যের অনুপাত এবং এক পণ্যের উৎপাদন সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের সঙ্গে আর এক পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের অনুপাত একই। “সমস্ত মূল্যই, সমস্ত পণ্যই হল ঘনীভূত শ্রম-সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিমাণ।”(১১)
সুতরাং একটি পণ্যের মূল্য অপরিবর্তিত থাকত, যদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময় লেগেছে তার কোন হ্রাসবৃদ্ধি না হত। কিন্তু এই শ্রম-সময় নামক জিনিসটির পরিবর্তন হয় শ্রমের উৎপাদনী শক্তি সমূহের প্রত্যেকটির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে। এই উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারিত হয় বহুবিধ অবস্থার দ্বারা, যার মধ্যে পড়ে, মজুরদের দক্ষতার গড় পরিমাণ, বিজ্ঞানের বিকাশ ও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের মাত্রা, উৎপাদনের সামাজিক সংগঠন, উৎপাদনের উপায়সমূহের প্রসার ও ক্ষমতা এবং দেশকালের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ ভালো মৌসুমে ৮ বুশেল শস্যের ভিতর ঠিক সেই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হবে, যা খারাপ মৌসুমে হবে মাত্র ৪ বুশেলের ভিতর। একটি খারাপ খনি থেকে যত লোহা বের করা যাবে তার চেয়ে বেশি যাবে একটি ভালো খনি থেকে। ভূপৃষ্ঠে হীরক অতি দুষ্প্রাপ্য, তাই তার আবিষ্কারে গড়পড়তা শ্রম-সময় প্রচুর ব্যয় হয়। তার ফলে তার অল্প একটুর ভিতর অনেক শ্রম থাকে। জ্যাকব-এর সন্দেহ সোনার পুরো দাম কেউ কখনো দিয়েছে কিনা। একথা আরো বেশি করে খাটে হীরক সম্বন্ধে। এশোয়েজ-এর মতে ১৮২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ৮০ বছরে ব্রাজিলের হীরক খনিতে মোট উৎপাদন যা হয়েছে, তাতে ঐ দেশের চিনি এবং কফি বাগানের দেড় বছরের গড় উৎপাদনের দাম ওঠেনি যদিও হীরকের জন্যে শ্রমের ব্যয় হয় অনেক বেশি এবং সেইজন্য তার মধ্যে মূল্য ঢের বেশি আছে। অপেক্ষাকৃত ভাল খনিতে ঐ একই পরিমাণ শ্রম অনেক বেশি হীরকের ভিতর সমাহিত হবে, এবং তার মূল্যও নেমে যাবে। আমরা যদি অল্প শ্রমের ব্যায়ে অঙ্গারকে হীরকে পরিণত করতে পারতাম, তার মূল্য ইটের চেয়েও কম হয়ে যেত। সাধারণতঃ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি যতই বেশি হবে, কোন জিনিসের উৎপাদনে শ্রম-সময় ততই কম লাগবে, সেই জিনিসটির ভিতর ততই কম পরিমাণ শ্রম মূর্ত হবে, তার মূল্য হবে ততই কম; বিপরীত ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীত হবে; শ্রমের উৎপাদনী শক্তি যত কম, দ্রব্যের উৎপাদনে শ্রম-সময় তত বেশি, তত বেশি তার মূল্য। সুতরাং কোন পণ্যের মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হয় তার ভিতরে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত থাকে তার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে এবং ঐ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে বিপরীতভাবে।
মূল্যে না থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিস ব্যবহারমূল্য হতে পারে। এব্যাপারে তখনও হয়, যখন মানুষের কাছে তার যা ব্যবহারিকতা, তা শ্রমজনিত নয়। যথা, বাতাস, কুমারীভূমি, প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্র প্রভৃতি।
একটি দ্রব্য পণ্য না হয়েও প্রয়োজনীয় হতে পারে এবং মানুষের শ্রম থেকে উৎপন্ন হতে পারে। যে-কেউ নিজ শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা সরাসরি নিজের অভাব পূরণ করে, সে অবশ্যই ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু পণ্য সৃষ্টি করে না। পণ্য উৎপন্ন করতে হলে তাকে কেবল ব্যবহার-মূল্য উৎপন্ন করলেই চলবে না, উৎপন্ন করতে হবে অপরের জন্য ব্যবহার-মূল্য, সামাজিক ব্যবহার-মূল্য। (কেবল অপরের জন্য হলেই হবে না, আরও কিছু চাই। মধ্যযুগের কৃষক তার সামন্ত প্রভুর জন্য উৎপন্ন করতো উঠ্বন্দী খাজনা দেবার শস্য এবং তার পাদ্রীর জন্য দেবোত্তর খাজনার শস্য। কিন্তু অন্যের জন্য উৎপন্ন হয়েছে বলেই উঠ্বন্দী খাজনার শস্য বা দেবোত্তর খাজনার শস্য পণ্য হত না। পণ্য হতে হলে, দ্রব্যকে বিনিময়ের মারফত হস্তান্তরিত হতে হবে অন্যের কাছে, সে যার ভোগে লাগবে তার হাতে ব্যবহারমূল্য হিসেবে।)(১২) সর্বোপরি ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্য না হয়ে, কোন কিছুই পণ্য হতে পারে না। দ্রব্যটি যদি অব্যবহার্য হয়, তার মধ্যে বিধৃত শ্রমও হবে অব্যবহার্য; ঐ শ্রম, শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, কাজে কাজেই তা মূল্য সৃষ্টি করে না।
——————-
১. “Zur kritik der politischen Oekonomie”, কার্ল মার্কস, বার্লিন, ১৮৫৯ পৃঃ ৩।
২. “কল্পনা বলতে বোঝায় অভাব, এটা হচ্ছে মনের ক্ষুধা, এবং শরীরের পক্ষে ক্ষুধা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি…মনের ক্ষুধা যোগানোর জন্যই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জিনিস মূল্যসম্পন্ন হয়।” নিকোলাস বারবো : “নোতুন মূদ্রা আরো হালকা করে তৈরী করা সম্পর্কে একটি আলোচনা “A Discourse Concerning Coining the New money lighter. মিঃ লকের ‘ভাবনা’র জবাবে”, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২, ৩।
৩. “অন্তর্নিহিত দ্রব্যসমূহের অভ্যন্তরীণ মূল্য আছে” (এটা হচ্ছে ব্যবহারগত মূল্য সম্পর্কে বারবোর উক্তি) “যার গুণ সর্বত্র একই : যেমন লৌহ-আকর্ষক চুম্বক”, (l.c পৃঃ ৬)। লৌহ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে চুম্বকের এই যে গুণ তা তখন থেকেই ব্যবহারে লাগানো হয় যখন চুম্বকের চৌম্বকত্ব আবিষ্কার হল।
৪. “যে কোন জিনিসের মূল্যগুণ থেকে মানব জীবনের প্রয়োজন মিটাবার ও সুখ-সুবিধা বিধানের সরবরাহের ক্ষমতার মধ্যে।” জন্ লক্ ‘সুদ হ্রাসের ফলাফল সম্পর্কে কয়েকটি ভাবনার কথা,’ (“Some Considerations on the consequences of the Lowering of Interest’) ১৬৯১, গ্রন্থাবলীতে সম্পাদিত, লণ্ডন, ১৭৭৭, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮। ১৭শ শতাব্দীরের ইংরেজ লেখকদের লেখায় আমরা হামেশাই ‘অর্থ’ কথাটা পাই ‘ব্যবহার মূল্য’ অর্থে এবং ‘মূল্য’ কথাটা ‘বিনিময় মূল্য’ অর্থে। টিউটনিক শব্দ দিয়ে আসল জিনিসটি বোঝানো এবং রোমান শব্দ দিয়ে তার প্রতিভাসটি বোঝানো যে ভাষার ঝোঁক, সেই ভাষায় কথা দুটি সুসঙ্গত।