এই সর্বপণ্যে বিদ্যমান “জিনিসটি” পণ্যের জ্যামিতিক, রাসায়নিক অথবা অপর কোনো নৈসর্গিক গুণ হতে পারে না। এই ধরনের গুণগুলি ততটাই মনোযোগ আকর্ষণ করে যতটা এগুলি নানা পণ্যের উপযোগিতাকে প্রভাবিত করে, যতটা তা পণ্যকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করে। কিন্তু পণ্যের বিনিময় স্বভাবতই এমন একটি ক্রিয়া যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্টতা। তাহলে, একপ্রকার ব্যবহারমূল্যের সঙ্গে আর একপ্রকার ব্যবহার-মূল্যের কোন তারতম্য থাকে না—যদি পরিমাণের দিক থেকে তা হয় যথেষ্ট। অথবা, বৃদ্ধ বারবন-এর কথামতো, “একপ্রকার সামগ্রী অন্য প্রকার সামগ্রীর অনুরূপ, যদি দুটোর মূল্য হয় সমান। সমান সমান মূল্যের জিনিসের মধ্যে কোন ভেদ বা পার্থক্য থাকে না…একশন পাউণ্ড দামের সীসার কিংবা লোহার মূল্য যা, একশত পাউণ্ড দামের রূপা কিংবা সোনার মূল্যও তাই।”(৮) ব্যবহার-মূল্য হিসেবে পণ্য সমূহের মধ্যে আছে, সবচেয়ে, যেটা বড় কথা,—যেটা ভিন্ন ভিন্ন গুণ কিন্তু বিনিময়-মূল্য হিসেবে আছে শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ, আর কাজে কাজেই তাদের মধ্যে ব্যবহার-মূল্যের অনু মাত্রই নেই।
তাহলে আমরা যদি পণ্যসমূহের ব্যবহার-মূল্যটা না ধরি তো তাদের সকলেরই একটি মাত্র অভিন্ন গুণ অবশিষ্ট থাকে—তারা সকলেই শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্য। কিন্তু এমন কি এই শ্রমজাত দ্রব্যও আমাদের হাতে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমরা যদি তার ব্যবহার-মূল্য থেকে তাকে বিশ্লিষ্ট করে আনি, তাহলেই তো আর যেসব উপাদান এবং আকার-প্রকার তাকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করেছে, তা থেকেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয়। আমরা তাকে আর টেবিল, বাড়ি, সুতো অথবা অন্য কোন ব্যবহারযোগ্য জিনিস হিসেবে দেখি না। বাস্তব জিনিস হিসেবে তার অস্তিত্ব অদৃশ্য করে রাখা হয়। তাকে আর সূত্রধর, রাজমিস্ত্রী, তন্তুবায় অথবা অন্য কারো কোন বিশিষ্ট শ্রমের উৎপাদন বলেও ধরতে পারি না। ঐ দ্রব্যগুলির নিজ নিজ ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিধৃত বিবিধ প্রকার শ্রমের ব্যবহারিকতা এবং বিশিষ্ট বিশিষ্ট বিমূর্ত রূপ—এই উভয়কেই আমরা হিসেবের বাইরে রাখি; তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, থাকে কেবল তাদের এক ও অভিন্ন গুণটি; তারা সবাই পর্যবসিত হয় একই রকম শ্রমে, অমূর্ত মানবিক শ্রমে।
এখন, এই সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান আছে সেই একই বিদেহী বাস্তবতা, বিশুদ্ধ সমজাতিক শ্রমের সংহত রূপ, ব্যয়ের প্রকার-নির্বিশেষে ব্যয়িত শ্রমশক্তির ঘনীভূত অবস্থা। আমাদের কাছে এই সমস্ত দ্রব্যের একমাত্র পরিচয় এই যে, এগুলি তৈরী করতে ব্যয়িত হয়েছে মানুষের শ্রমশক্তি, মানবিক শ্রম এগুলির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে। এই দ্রব্যগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই এই যে সামাজিক বস্তুটি বিদ্যমান তার স্ফটিক হিসেবে দেখলে এগুলিই হল—মূল্য।
আমরা দেখেছি যে পণ্যের সঙ্গে পণ্যের যখন বিনিয়ম হয়, তাদের বিনিময়-মূল্য ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ব্যবহার-মূল্য থেকে যদি তাদেরকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, তাহলে বাকি থেকে মূল্য, যার সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যখনি পণ্যের বিনিময় হয়, তখনি যে এক ও অভিন্ন বস্তুটি তার বিনিময়-মূল্যের ভিতর আত্মপ্রকাশ করে, তা হচ্ছে তার মূল্য। আমাদের অনুসন্ধান যখন আরও অগ্রসর হবে, তখন দেখতে পাব যে একমাত্র এই বিনিময়মূল্য রূপেই পণ্যের মূল্য প্রকট হতে বা আত্মপ্রকাশ করতে পারে! আপাতত, অবশ্য, আমরা মূল্যের রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা কার্য চালাব।
অতএব, ব্যবহার-মূল্যের বা ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের মূল্য আছে শুধু এই জন্য যে তার ভিতরে বিশ্লিষ্ট শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করেছে অথবা বস্তুরূপে রূপায়িত হয়ে আছে। তাহলে এই মূল্যের আয়তন মাপা যাবে কি করে? সোজাসুজি বললে, তা মাপা যায় মূল্য সৃজনকারী জিনিসের, অর্থাৎ দ্রব্যের অভ্যন্তরস্থ শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই শ্রম-সময় দিয়ে ঠিক করা হয়। আর শ্রম-সময় পরিমাপের মান হচ্ছে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, পণ্যের মূল্য যদি নির্ধারিত হয় যে-পরিমাণ শ্রম তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে, তাহলে তো শ্রমিক যত বেশি অলস এবং অপটু হবে, তার পণ্য হবে তত বেশি মূল্যবান, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যে তার লেগে যাবে বেশি সময়। যে শ্রম-মূল্য সৃষ্টি করে তা অবশ্য সমজাতিক মনুষ্য-শ্রম, এক ও অভিন্ন শ্রমশক্তির ব্যয়। সমাজ কর্তৃক উৎপন্ন সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যের ভিতর যে পরিমাণ শ্রমশক্তি আছে, এখানে সমাজের সেই মোট শ্রমশক্তিকে ধরা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তির একটি সমজাতিক স্তুপ হিসেবে, সেই স্তূপটি অবশ্যই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন এককের সমষ্টি। প্রত্যেকটি এককই অবিকল অন্য আরেকটি এককের মতো—এই হিসেবে যে, তার চরিত্র এবং কার্যকারিতা হল সমাজের গড় শ্রমশক্তির অনুরূপ। অর্থাৎ, একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তা গড়পড়তা শ্রমশক্তির বেশি নয়, তা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের অনধিক। উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং সমসাময়িক গড় দক্ষতা ও তীব্রতা সহ শ্রম করলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগে, তাকেই বলে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়। ইংল্যাণ্ডে বাষ্প-চালিত তাঁত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো দিয়ে কাপড় বুনবার সময় কমে গিয়ে সম্ভবত অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। বস্তুতঃ হস্তচালিত তাঁতে তখনো তন্তুবায়দের লাগতো আগের মতো সময়। কিন্তু তা হলেও তাদের এক ঘণ্টার শ্রম থেকে উৎপাদিত সামগ্রী এই পরিবর্তনের ফলে আধ ঘণ্টায় উৎপন্ন সামগ্রীর সমান হয়ে পড়েছিল, এবং তার ফলে তার মূল্য কমে হয়ে গিয়েছিল আগের অর্ধেক।