এ সবকিছুই তিনি খুলে বললেন।
কিন্তু তাঁর হৃদয়ে না-বলা রয়ে গেল অনেক বেশিকিছু।
নিজেই নিজের গভীরতর গোপনকে তিনি উন্মোচন করতে পারেন না,
এবং তিনি নগরে প্রবেশ করলে নগরবাসী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এল এবং তারা তখন অঝোরে কাঁদছিল এবং তাদের কান্নার শব্দ ছিল একটাই।
নগরীর বয়োবৃদ্ধরা সামনে এসে দাঁড়াল এবং বলল, আমাদের ছেড়ে আর যাবেন না, আপনি হলেন মধ্যাহ্ন আমাদের গোধূলিবেলায় এবং আপনার যৌবন আমাদেরকে দিয়েছে। স্বপ্ন-দেখার স্বপ্ন।
আমাদের ভেতরে আপনি কোনো আগন্তুক নয়, নয় একজন অতিথি, বরং আমাদের সন্তান এবং অত্যন্ত প্রিয় সন্তান।
আমরা কষ্ট পাই ততক্ষণ যতক্ষণ-না আমাদের দৃষ্টি আপনার মুখের জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে।
এবং যাজক ও যাজিকারা বলল :
সমুদ্রের ঢেউ যেন এখন আমাদেরকে আলাদা না করে
এবং যে-বছরগুলি আপনি আমাদের ধোঁয়াশার
ভেতরে কাটিয়েছেন তা পরিণত হয়েছে স্মৃতিতে।
আপনি আত্মার মতো আমাদের ভেতরে চলাচল করেছেন
এবং আপনার ছায়া আলোকিত করেছে আমাদের মুখমণ্ডল।
আপনাকে খুবই ভালোবেসেছি আমরা।
কিন্তু নির্বাক ছিল আমাদের ভালোবাসা এবং তা ছিল অবগুণ্ঠনে অবগুণ্ঠিত।
এখনও পর্যন্ত তা আপনার কাছে ক্রন্দন করছে
এবং আপনার সামনেই সে সবকিছু ফাস করে দেবে।
এবং কখনও এমন হয়েছে যে, পৃথকীকরণের সময় না-আসা পর্যন্ত ভালোবাসা নিজের গভীরতা জানতে পারে না।
অন্যেরাও এল এবং তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাল।
কিন্তু তিনি তাদের কথার কোনো উত্তর দিলেন না।
শুধুমাত্র তিনি তার মাথাটা নোয়ালেন এবং কাছে যারা দাঁড়িয়েছিল প্রত্যেকেই দেখল তার বুকের ওপর অশ্রু ঝরে পড়ছে।
এবং তিনি ও জনতা মন্দিরের সামনের বিশাল চত্বরের দিকে এগোলেন।
সেই চত্বরে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল এক নারী, যার নাম আলমিতরা এবং সে ছিল একজন ভবিষ্যদ্রষ্টা।
চূড়ান্ত স্নেহের দৃষ্টিতে তিনি সেই নারীর দিকে তাকালেন, কারণ এটা ছিল সেই নারী যে তাকে প্রথম অন্বেষণ করে
এবং তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে যখন তিনি পুরো একদিন তাদের নগরীতে কাটিয়েছিলেন।
এবং সেই নারী তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলে :
হে ঈশ্বরের প্রেরিতপুরুষ, সর্বশ্রেষ্ঠ উচ্চারণকারীর সন্ধানে আপনার জাহাজের জন্য অনুসন্ধান করেছেন গভীর দূরত্ব।
এখন আপনার জাহাজ এসেছে এবং আপনার অবশ্যই যাওয়া প্রয়োজন।
আপনার অসংখ্য স্মৃতির ভূমি এবং বৃহত্তম বাসনার বসতির জন্য আপনার গভীর আকাঙ্ক্ষা এবং আমাদের ভালোবাসা আপনাকে বেঁধেও রাখবে না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে ধরেও রাখবে না।
যদিও আপনি আমাদের পরিত্যাগ করার আগেই আমরা তা জিজ্ঞাসা করি, যা আপনি আমাদেরকে বলেন এবং আপনার সত্য আমরা জানতে পারি।
আমরা এই সত্যগুলো পৌঁছে দেব আমাদের শিশুদের কাছে এবং তারা তা পৌঁছে দেবে তাদের শিশুদের কাছে এবং এই সত্য কখনই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে না।
আপনার একাকিত্বের ভেতরে আপনি পর্যবেক্ষণ করেছেন আমাদের দিনগুলি এবং আপনার জাগরণের ভেতরে শুনেছেন আমাদের ঘুমন্ত অস্তিত্বের হাসি ও কান্না।
সুতরাং আমাদেরকে এখন আমাদের কাছে উন্মোচন করুন এবং আমাদেরকে বলুন জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের সেইসব যা আপনাকে দেখানো হয়েছে।
এবং তিনি উত্তরে বলেন :
যে অর্ফালিজবাসী, আমি সেইসব ছাড়া কি বলতে পারি, এমনকি যা এখন তোমাদের আত্মার ভেতরে চলাচল করছে?
তখন আলমিরা বলল :
আমাদেরকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলুন।
তিনি মাথা তুলে জনতার দিকে তাকালেন, জনতা স্থির হয়ে গেল এবং তিনি উদাত্ত কণ্ঠে বললেন :
যখন ভালোবাসা তোমাদের ঈশারায় ডাকে তখন তাকে অনুসরণ করো যদিও তার পথ কঠিন এবং আরোহণযোগ্য নয়।
এবং যখন তার পাখা তোমাদের আলিঙ্গন করে তখন তোমরা তার বশ্যতা স্বীকার করো, যদিও তার পালকের ভেতরে লুকানো তরবারি তোমাদের আহত করতে পারে।
এবং যখন ভালোবাসা কথা বলে তোমরা তা বিশ্বাস করো, যদিও তার কণ্ঠস্বর তোমাদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে, যেভাবে উত্তরে বাতাস উদ্যানকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়।
ভালোবাসা তোমাদেরকে যেমন মুকুট পরাবে তেমনি ক্রুশবিদ্ধ করবে আবার।
এমনকি এই ভালোবাসা তোমাদের ক্রমোন্নতির জন্য, আবার এই ভালোবাসাই তোমাদের জন্য কাস্তে হয়ে ওঠে।
এমনকি সে আরোহণ করে তোমাদের মাথার ওপরে এবং স্নেহের স্পর্শ দেয় তোমাদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর শাখাগুলিকে যা সূর্যালোকে শিহরিত হয়।
সুতরাং ভালোবাসা কি তোমাদের শেকড়ের কাছে নেমে যাবে এবং নাড়া দেবে শেকড়সুদ্ধ পৃথিবীকে?
তোমাদেরকে সে জড়ো করে তার কাছে শস্যের আঁটির মতো। দলে-মুচড়ে সে তোমাদেরকে নগ্ন করে ফেলে।
তোমাদের খোলস থেকে তোমাদেরকে মুক্ত করতে ভালোবাসা তার চালুনি দিয়ে তোমাদের হেঁকে নেয়।
চূর্ণ-বিচুর্ণ করে সে তোমাদের উজ্জ্বলতা।
নমনীয় না-হওয়া পর্যন্ত সে তোমাদের ময়দার মতো পিষে ফেলে এবং তারপর তার পুত পবিত্র অগ্নির দায়িত্ব অর্পণ করে তোমাদের, যা তোমাদেরকে পবিত্র রুটিতে পরিণত করতে পারে ঈশ্বরের পবিত্র ভোজ-উৎসবের জন্য।
ভালোবাসা তোমাদের প্রতি এই সবকিছুই করবে, তোমরা যা তোমাদের হৃদয়ের গোপনীয়তার কাছে জেনে নিতে পারো এবং সেই জ্ঞানের ভেতরে পরিণত হও জীবনের অন্তরতম প্রদেশের খণ্ডাংশে।
কিন্তু তোমরা যদি আতঙ্কগ্রস্ত হও তাহলে শুধুমাত্র অনুসন্ধান করবে ভালোবাসার শান্তি ও ভালোবাসার আনন্দ।
তবে তোমাদের নগ্নতাকে তোমরা ঢেকে ফেলো এবং বেরিয়ে এসো ভালোবাসার মাড়াইখানা থেকে এবং এটা তোমাদের জন্য উত্তম।
ঋতুহীন পৃথিবীতে তোমরা যেখানে হেসে উঠবে তার সবগুলিই তোমাদের হাসি নয়, নয় তোমাদের কান্না, এমনকি তা নয় তোমাদের অশ্রুবিন্দুগুলি।
ভালোবাসা উপহার দেয় না কিছুই শুধুমাত্র ভালোবাসা ছাড়া এবং একমাত্র নিজেকে ছাড়া গ্রহণ করে না কোনোকিছু।
ভালোবাসা ভোগদখল করে না, এমনকি নিজেও কারও অধিকারে আসে না,
কারণ ভালোবাসার প্রতি ভালোবাসাই যথেষ্ট।
যখন তোমরা ভালোবাসো তখন বলা উচিত নয়,
‘ঈশ্বর আমার হৃদয়ে আছেন,’ বরং বলল, ‘ঈশ্বরের হৃদয়ে আমি আছি।’
এবং ভাবো, তোমরা কেউই ভালোবাসার গতিপথ পরিচালনা করতে পারো না ভালোবাসার জন্য,
যদি ভালোবাসা তোমাদের মূল্যবান মনে করে তাহলেই তোমাদের গতিপথ পরিচালনা করে।
ভালোবাসার অন্যকোনো আকাঙ্ক্ষা নেই নিজেকে পরিপূর্ণ করা ছাড়া। কিন্তু যদি তোমরা ভালোবাসো এবং নিশ্চিতই আকাক্ষার প্রয়োজন হয় তাহলে সেগুলিকে তোমাদের আকাক্ষা হতে দাও:
তাকে গলে যেতে এবং প্রবহমান নদীর মতো হয়ে উঠতে দাও, রাত্রির কাছে তার সুরের সংকেত দেয় অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতার বেদনা জানতে,
আহত হতে ভালোবাসার নিজস্ব বোঝাবুঝি দ্বারা এবং স্বেচ্ছায় ও আনন্দের সঙ্গে রক্তাক্ত হতে।
কোনো সকালে পাখাবিশিষ্ট হৃদয় নিয়ে জেগে উঠতে এবং ধন্যবাদ জানাতে ভালোবাসার অন্যকোনো দিনকে,
অবসর নিতে মধ্যাহ্নবেলায় এবং গভীরভাবে বিবেচনা করতে ভালোবাসার পরমানন্দ। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে আসতে এবং তারপর তোমাদের হৃদয়ের অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের মানুষের জন্য প্রার্থনার সঙ্গে ঘুমাতে এবং তোমাদের ওষ্ঠে তখন প্রশংসার সংগীত।