মোস্তফা মীর
ঢাকা ০১.০২.২০০৯
১. নবী [দ্য প্রফেট]
অত্যন্ত প্রিয় ও পছন্দের আলমুস্তাফা ছিলেন তার সময়ের সুপ্রভাত, যিনি বারো বছর ধরে অর্ফালিজ নগরীতে অপেক্ষা করেছিলেন তার জাহাজের জন্য–যে জাহাজ ফিরে এসেছিল এবং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার জন্মের ক্ষুদ্রদ্বীপে।
এবং বারো বছরের সেই বিশেষ মাসের সপ্তম দিনে অর্থাৎ ফসল-তোলার মাসে তিনি নগরপ্রাচীরের সাহায্য ছাড়াই পাহাড়ে উঠলেন, তাকালেন সমুদ্রের দিকে এবং দেখতে পেলেন তাঁর জাহাজ ধোঁয়াশার সঙ্গে এগিয়ে আসছে।
তারপর ঝড়ের বেগে খুলে গেল তার হৃদয়ের দরজা এবং তার আনন্দ উড়াল দিল সমুদ্রের ওপর দিয়ে। এবং তিনি চোখ বন্ধ করে আত্মার নীরবতার ভেতরে প্রার্থনা করলেন।
কিন্তু পাহাড়ে অবতরণের পর এক দুঃখবোধ এসে তাকে ঘিরে ধরে এবং তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন- কীভাবে আমি শান্তির ভেতরে প্রবেশ করব, দুঃখ ছাড়া?
শুধু তাই নয়, অন্তরে আঘাত না-পাওয়া ছাড়াই এই নগর আমি পরিত্যাগ করব?
যন্ত্রণার দীর্ঘদিন এবং একাকিত্বের দীর্ঘ রাত্রিগুলি আমি এই নগরীর দেয়ালের ভেতরে কাটিয়েছি এবং কে পারে অনুতাপ ছাড়া তার একাকিত্ব ও যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে যেতে।
আত্মার অসংখ্য টুকরো আমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছি এসব রাস্তায় এবং আমার আকুল। আকাক্ষার অসংখ্য শিশু নগ্ন অবস্থায় এসব পাহাড়ের ভেতরে হেঁটে বেড়ায়। কোনো গুরুভার অথবা ক্রমাগত অস্বস্তিকর বেদনা ছাড়া আমি তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারি না।
এটা কোনো পোশাক নয়, যা এই দিনে পরিত্যাগ করি কিন্তু আমি নিজের দুহাতে ছিন্নভিন্ন করি চামড়া,
এটা কোনো চিন্তাও নয় যা পিছনে ফেলে এসেছি, কিন্তু একটি হৃদয় তৈরি হয়েছিল যা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় সুমিষ্ট।
যদিও আমি কোনোভাবেই কালিমা লেপন করতে পারি না।
সমুদ্র সবকিছুকেই আহ্বান জানায়, এমনকি আমাকে পর্যন্ত এবং অবশ্যই আমাকে জাহাজযাত্রা শুরু করতে হবে।
কেননা, থেকে গেলে রাত্রির প্রতিটি ঘণ্টাই পুড়ে যাবে, হিমায়িত হবে, স্ফটিকাকার ধারণ করবে এবং আবদ্ধ হবে একটি ছাঁচে।
আমি কি এখানকার সবকিছুই সঙ্গে নিয়ে যাব? কিন্তু কীভাবে আমি তা করব?
একটি কণ্ঠস্বর জিভকে বহন করতে পারে না এবং ঠোঁটদুটো সেই কণ্ঠস্বরকে পাখা দিয়েছিল। অবশ্যই একাকী অনুসন্ধান করতে হবে সেই কণ্ঠস্বরকে ইথারের ভেতরে।
এবং একাকী ঈগল তার বাসা ছাড়াই সূর্যের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যাবে।
যখন পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তিনি আবার সমুদ্রের দিকে ফিরলেন এবং দেখতে পেলেন, তার জাহাজ পোতাশ্রয়ের নিকটবর্তী, জাহাজের অগ্রভাগে নাবিকরা তার নিজ বাসভূমের মানুষেরা।
তাদের দেখে তাঁর আত্মা তখন কেঁদে উঠল এবং তিনি বললেন:
আমার প্রাচীন মাতার পুত্রসন্তানেরা, তোমরা স্রোতারোহী। কীভাবে তোমরা প্রায়ই আমার স্বপ্নের ভেতরে সমুদ্রে ভেসে গেছ। এবং এখন তোমরা এসেছ আমার জাগরণে, যা কিনা আমার গভীরতর স্বপ্ন।
বাতাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা নাবিকদের সঙ্গে আমি এবং আমার ব্যাকুলতা ভেসে যেতে প্রস্তুত।
শুধুমাত্র অন্য প্রশ্বাস যা আমি গ্রহণ করব এই নিশ্চল বাতাসে, শুধুমাত্র ভালোবাসাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করব পেছনদিকে।
এবং তারপর আমি তোমাদের ভেতরে দাঁড়াব, সমুদ্রযাত্রীদের ভেতরে একজন সমুদ্রযাত্রী।
এবং তুমি, বিশাল সমুদ্র, ঘুমন্ত মাতা,
নদী ও স্রোতের কাছে একাকী কারা হয় শান্তি ও স্বাধীনতা, শুধুমাত্র অন্য বায়ুপ্রবাহ তৈরি করবে এই স্রোত, শুধুমাত্র অন্য মর্মরধ্বনি শোনা যাবে বনের ভেতরের উন্মুক্ত প্রান্তরে। এবং তখন আমি তোমাদের কাছে আসব- একটি উন্মুক্ত সমুদ্রে একটি উন্মুক্ত জলবিন্দু।
এবং তিনি হেঁটে আসতেই দেখতে পেলেন, দূরে নারী ও পুরুষেরা ফিরে আসছে তাদের মাঠ ও আঙুরক্ষেত থেকে এবং ছুটে চলেছে নগরতোরণের দিকে।
এবং তিনি শুনতে পেলেন তাঁর নাম ধরে তারা ডাকছে এবং মাঠ থেকে মাঠে একে অন্যকে চিৎকার করে বলছে, ‘তার জাহাজ আসছে।’
এবং তিনি নিজেকে বললেন :
বিচ্ছিন্নতার এই দিন কি জনসমাবেশের দিনে পরিণত হবে? এবং বলবে কি আমার সুপ্রভাতে আমার ঈভ [পৃথিবীর প্রথম নারী হাওয়ার বাইবেলকৃত নাম] ছিল সত্যের ভেতরে?
এবং আমি তাকে কি দেব যে হলরেখায় তার লাঙল ফেলে এসেছে অথবা যে বন্ধ করে রেখেছে তার আঙুর-পেষণকারী যন্ত্রের চাকা?
আমার হৃদয় কি হবে একটা ফলে বোঝাই গাছ, যা থেকে আমি ফল জড়ো করতে পারি এবং তাদের বিলিয়ে দিতে পারি?
এবং আমার ইচ্ছাগুলি কি প্রস্রবণের মতো প্রবাহিত হবে যেখান থেকে আমি পারি তাদের কাপ পূর্ণ করে দিতে?
আমি কি একটি বাদ্যযন্ত্র, পরাক্রমশালীর হাত আমাকে ছুঁয়ে যেতে পারে অথবা একটি বাঁশি, যার নিশ্বাস আমার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে যেতে পারে আমাকেই?
.
আমি কি একজন নীরবতা অন্বেষণকারী এবং কী সম্পদ আমি নীরবতার ভেতরে আহরণ করেছি তা কি আস্থার সঙ্গে বণ্টন করতে পারি?
এটা হয় যদি আমার ফসল-তোলার দিন তাহলে কোন্ মাঠে বপন করেছি বীজ এবং কোন্ সেই ঋতুগুলিতে,
যা স্মরণ করা হয় না কখনই?
অন্ততপক্ষে এটা যদি হয় সেই সময় যখন আমি আমার লণ্ঠন তুলে ধরি, এটা নয় আমার শিখা যা আমাতেই পুড়ে যাবে।
শূন্যতা ও অন্ধকারে, আমি আমার লণ্ঠন তুলে ধরব, রাত্রির অভিভাবক লণ্ঠন তেলে পূর্ণ করে দেবেন এবং নিজেই জ্বেলে দেবেন আলো।