তারপর বিচ্ছিন্নভাবে তার কিছু কবিতার অনুবাদ পড়েছি। কিন্তু জিবরান যেহেতু উইলিয়াম ব্লেকের মতো কবি ও চিত্রকর সে-কারণে তার নামটি স্মৃতিতে ছিল খুবই আলাদাভাবে। প্রফেট গ্রন্থের কিছু ছবি আমি তখন মুগ্ধ হয়ে দেখেছি। ২০০০ সালের অক্টোবরে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য গিয়ে প্রায় দুমাস হাসপাতালে থাকার পর দিল্লি যাওয়ার একটা সুযোগ হল। দিল্লিতে এসে শরীর ভালো না-থাকায় তেমন ঘোরাঘুরি করতে পারিনি। ফলে টেলিফোনে বড় বড় প্রকাশকের দোকানে খোঁজ নিতে লাগলাম জিবরানের ডায়রি, আত্মজীবনী কিংবা চিঠিপত্র পাওয়া যায় কী না। কিন্তু সফল হইনি। দু-একজন প্রফেট প্রাপ্তির কথা বললেও আমি যা চাই তা পেলাম না।
২০০১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় ফেরার তিনদিন পর এক অনুজপ্রতিম তরুণ বন্ধু আমাকে ‘দ্য লাভ লেটারস অব কহলীল জিবরান পড়তে দেয়। আমি তো আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠি, আরে! এই বইটাই তো আমি ভারতের রাজধানী শহরে খুঁজেছি তন্নতন্ন করে। কারণ এই অদ্ভুত মানুষটির জীবনযাপন সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল প্রবল। যাহোক কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতের কাছে পেলাম, শুরু হল পড়ার কাজ। বারদুয়েক পড়ার পর মনে হল, সনাতন প্রেমের কোনো কথাবার্তা এখানে নেই, তবে চিঠিগুলির অসম্ভব সাহিত্যমূল্য রয়েছে যা জিবরান-বিশেষজ্ঞ ও জিবরান-প্রেমিকদের কাছে এক অমূল্য সম্পদ বলে বিবেচিত হতে পারে। চিঠিগুলির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এর কথনভঙ্গি এবং বাক্য রচনারীতি। জিবরানের চিঠি পড়লে মনে হবে যেন তিনি এবং মে মুখোমুখি বসে কথা বলছেন।
২
জিবরানের প্রেমেরে চিঠি অনুবাদের পর অনুবাদ করি তার ‘দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট। ক্রমশ তাঁর লেখার প্রতি আমার আগ্রহ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একই সঙ্গে চলতে থাকে তাঁর গ্রন্থগুলি সংগ্রহের কাজ। কিন্তু কোনো প্রকাশকই এই বিশাল রচনাবলি ছাপাতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। অবশেষে ২০০৭ সালে অনিন্দ্য প্রকাশের মালিক আফজাল হোসেন এই রচনাবলি প্রকাশের আগ্রহ দেখালে ২০০৭ সালেই জিবরানের পনেরোটি গ্রন্থের অনুবাদের কাজ শেষ করি। এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি হচ্ছে, নবী (দ্য প্রফেট), নবীর বাগান (দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট), পৃথিবীর ঈশ্বরেরা(দ্য আর্থ গডস), বালি ও ফেনা (স্যাণ্ড এণ্ড ফোম), পথভ্রষ্ট (দ্য ওয়াণ্ডারার), পাগল (দ্য ম্যাডম্যান), অগ্রদূত (দ্য ফোর রানার), উপত্যকার পরী (নিফ অব দ্য ভ্যালি), কান্না এবং উচ্চহাসি (টিয়ারস এন্ড লাফটার), কহলীল জিবরানের প্রেমের চিঠি (দ্য লাভ লেটারস অব কহলীল জিবরান), রাত্রি ও সকালের মাঝখানে (বিটুইন নাইট এণ্ড মন), হৃদয়ের গোপনীয়তা (সেক্রেটস অব দ্য হার্ট), আত্মার বিদ্রোহ (স্পিরিটস রেবেলিয়াস), ভাঙা ডানা (দ্য ব্রোকেন উইংস) ও মানুষের পুত্র যিশু (জেসাস দ্য সান অব ম্যান)।
ভাষান্তরের ক্ষেত্রে মূলের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করেছি, আরও চেষ্টা করেছি জিবরানের কথনভঙ্গিকে তার মতো করেই পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। তবে কোনো কোনো জায়গায় মৃদু আক্ষরিক মনে হতে পার এবং বাধ্য হয়েই তা করতে হয়েছে, তা না হলে অনুবাদে জিবরানকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এছাড়া জিবরানের একটা অদ্ভুত স্টাইল রয়েছে, যাকে আমি জিবরানীয় স্টাইল বলতে চাই। বিশ্ব সাহিত্যে এই স্টাইলে কোনো কবি বা কথা সাহিত্যিককে কথা বলতে দেখি নাই–এ স্টাইল একেবারেই তার নিজস্ব, যা দীর্ঘ বাক্য গঠনের প্রক্রিয়াকে আয়াসসাধ্য করে তোলে চিন্তা ও মননের ঐক্যের ভেতরে। জিবরান মূলত ছিলেন দার্শনিক এবং সেই দার্শনিকতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিত্বের ভেতর দিয়ে।
জিবরান সাধারণ পাঠকের জন্য নয়। সাধারণ পাঠক জিবরান পড়ে মোটেও আনন্দ পাবে না। শুধু মাত্র শিক্ষিত এবং মেধাবী পাঠকেরাই জিবরানের রচনার রস আস্বাদন করতে সক্ষম এবং একমাত্র তারাই উপলব্ধি করতে পারবেন যে কালের ধূলোর ওপর দাঁড়িয়ে তিনি খেলা করেছেন মরমী দার্শনিকের এক অবাস্তব জগৎ নিয়ে। জিবরানের রচনা পড়লে তাঁর যে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির স্পর্শ পাওয়া যায় তাকে আমরা প্রথম শ্রেণীর বলতে পারি এবং কবি ও কথাসাহিত্যিকদের জন্য তাঁর গ্রন্থপাঠ অপরিহার্য, কারণ তিনি ছিলেন কবিদের কবি এবং উপন্যাসিকদের উপন্যাসিক-লেখালেখি ও চিত্রকলার পেছনেই তিনি প্রতিটি দিন ও রাত্রির সারাটা সময় কাটাতেন। শিল্পের জন্য নিবেদিত একটি প্রাণ উদ্ভট মানসিকতা নিয়েও নির্মাণ করেছে শিল্পোত্তীর্ণ কাব্য ও চিত্রকলা। সে সময়ের ফরাসি ও ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকেরা তার শিল্পকর্মকে তুলে ধরার জন্য নিজেদের উদ্যোগে জিবরানের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। তাঁর কবিতা ও ছবি উভয়ই প্রশংসিত হয়েছে তার জীবিতাবস্থায়। সবকিছুর পর জিবরান হচ্ছেন দ্বিতীয় ব্লেক, নতুন ব্লেক-যার ছবি ও কবিতা উভয়ই উভয়ের পরিপূরক।
৩
জিবরান আমার প্রিয় লেখকদের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছেন দীর্ঘদিন ধরে। জিবরান হলেন আমার কাছে সেরকম একজন লেখক যার লেখা পড়ে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকা অবস্থায় সুস্থ হয়ে উঠি নিজের ভেতরে। জিবরান তার রচনায় এমন একটা জগতকে আবিষ্কার করেছেন পাঠক যার ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে মুগ্ধ হবে, তারপর আছন্ন হয়ে থাকবে এবং তারপর সে উদ্বুদ্ধ হবে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য উচ্চারণ করতে। আমার উদ্দেশ্য কহলীল জিবরানকে বাঙালি পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অনুবাদে কতটা সফল হয়েছি তা বিচারের ভার পাঠকের ওপর ছেড়ে দিলাম। তবে আগামী দিনে যারা লেখালেখি করবেন এই গ্রন্থ তাদেরকে জিবরানের চিন্তা-ভাবনার জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। গ্রন্থটি পাঠকের ভালো লাগলে নিজের পরিশ্রম সার্থক মনে করব।