ক্রমশ বহু মত বিনিময়ের পর তাদের সম্পর্ক পরিবর্তিত হয় পরস্পারিক বোঝাবুঝি থেকে দৃঢ় বন্ধুত্বে। কিন্তু চূড়ান্ত ভালোবাসায় পরিণত হওয়ার আগে তাঁদের সম্পর্ক দোদুল্যমানতার শিকার হয়। তারপরও মে তার হৃদয়ের উপলব্ধির কথা বলতে অথবা আবেগপূর্ণ শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে বারবার আক্ষেপ করেছেন। ফলশ্রুতিতে জিবরানের সঙ্গে একাধিকবার ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে এবং প্রতীকী ব্যাখ্যার মাধ্যমে পরপর অনেকগুলি চিঠি লিখে মে প্রকাশ করেছেন তার আবেগকে :
‘তোমার প্রতি আমার আবেগোত্মাসকে তুমি কী মনে করো? প্রকৃতপক্ষে আমি জানি না এসবের মাধ্যমে আমি কী বোঝাতে চাই। কিন্তু আমি জানি তুমি আমার প্রিয়জন এবং আমি তোমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করি। তবে স্বজ্ঞানে আমি বলছি যে, অল্প ভালোবাসাই। বিশাল এবং মহৎ। দারিদ্র্য ও ক্লেশ ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে থাকে এবং ভালোবাসাহীন সম্পদের চেয়ে শুধু ভালোবাসাও অধিক উত্তম। কোন্ সাহসে আমি তা বলি? এসব করে আমি তাদেরকে হারাব… তা সত্ত্বেও আমি তা করব। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, আমি সবকিছুই লিখছি কিন্তু তা বলছি না, কারণ তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে আমি সঙ্কোচে নিজেকে তোমার কাছ থেকে দীর্ঘসময় দূরে সরিয়ে রাখতাম এবং আমার কথাগুলো ভুলে না-যাওয়া পর্যন্ত পুনরায় আমাকে দেখার অনুমতি তোমাকে দিতাম না।
তারপরও তোমাকে লেখার জন্য নিজেকেই দোষী করছি এজন্য যে, লেখার ভেতরে আমি অতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করছি …. এবং আমি প্রাচ্যের শ্রদ্ধেয় পুরুষদের উচ্চারিত শব্দাবলি স্মরণ করছি, ‘একজন যুবতী নারী কখনই পড়বে বা শিখবে না এবং সেটাই হচ্ছে উত্তম।’ এ বিষয়ে এসে সন্দেহ আমার মুখোমুখি হয়। এর সঙ্গে কী বংশগতির কোনো সম্পর্ক আছে অথবা তার চেয়েও অধিক গভীর কিছু? এটা কী? দয়া করে আমাকে বলল এটা কী? আমাকে বলল আমি সঠিক পথে চলছি না ভুল পথে? কারণ আমি তোমাকে। বিশ্বাস করি, বিশ্বাস করি তুমি যা বলো তা-ই। আমার পথ ভুল বা সঠিক যাই হোক না। কেন আমার হৃদয় তোমার হৃদয়ে পথ খুঁজে পেয়েছে এবং তোমাকে ঘিরে এর আবর্তিত হওয়া উচিত নিজেকে ও তোমাকে রক্ষা করার জন্য।
দূরের দিগন্তরেখার সূর্য ভাসছে এবং আগন্তুক মেঘের ভেতর থেকে অদ্ভুত আকারের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র আবির্ভূত হয়েছে যার নাম ভেনাস-ভালোবাসার সম্রাজ্ঞী। আমি বিস্মিত হই যে, এই নক্ষত্র আমাদের মতো লোকদের প্রতিবেশী, যারা ভালোবাসার আকাক্ষায় পরিপূর্ণ। এটা কখনই হতে পারে না যে ভেনাস আমার মতো এবং তারও নিজস্ব জিবরান আছে–যে দূরে থাকে–বাস্তবতার ভেতরে যার চমৎকার উপস্থিতি এবং সম্ভবত এই মুহূর্তে সে চিঠি লিখছে না, সে দিগন্তে গোধূলিলগ্নে কেঁপে কেঁপে জ্বলছে। এটা জেনে অন্ধকার অনুসরণ করবে গোধূলিলগ্নকে এবং আলো অনুসরণ করবে অন্ধকারকে এবং সেই রাত্রি অনুসরণ করবে দিনকে এবং দিন অনুসরণ করবে রাত্রিকে এবং এটা চলতে থাকবে তার প্রিয়জনকে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত। সুতরাং গোধূলিলগ্নের এবং রাত্রির সমস্ত একাকিত্ব বুকে হেঁটে তার ওপরে উঠে যায়। তখন সে কলম সরিয়ে রাখে একপাশে এবং একটা নামের বর্মের পেছনের অন্ধকারের কাছ থেকে সে প্রত্যাখ্যাত হয়–সেই নামটি হচ্ছে জিবরান।’ [১৯২৪ সালের ১৫ জানুয়ারি জিবরানকে লেখা মে-এর চিঠি]
জিবরানের চিঠি কখনই সাধারণ ভালোবাসার বিশেষণে সমৃদ্ধ ছিল না। তিনি মে-কে চিঠি লিখেছেন–মনে হয় নিজেকেই শোনাচ্ছেন শৈশব, স্বপ্ন ও প্রাচ্যের জন্য তাঁর আকাক্ষার কথা। জিবরানের অনেক চিঠির পাশে আঁকা স্কেচ বা ড্রইং প্রমাণ করে যে, মে-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তিনি কত সহজ করে তুলেছিলেন এবং মে তার কত কাছে ছিল। একইভাবে নিমন্ত্রণপত্র ও বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা ছবি পাঠাতেন মে-কে এবং এর অর্থ হল, একটা তীব্র ধারণা দেওয়া যে, জিবরান কীভাবে দিনের পর দিন মে-এর সঙ্গে বসবাস করেছেন কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও।
এই চিঠিগুলির সাহিত্যমূল্য মোটেই অগ্রাহ্য করার মতো নয়। তবে এ পর্যন্ত একটা অনুমান মৃদু বিতর্কের জন্ম দেয় এবং তা হল জিবরানের জন্মতারিখ। তার জীবনীকারদের কেউ বলেছেন ১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাস, কেউ বলেছেন ডিসেম্বর মাস। তাঁর জন্মতারিখ নিয়ে এই জটিলতার বিষয়টি তিনি তার একটা চিঠিতেও উল্লেখ করেছেন। মে জিয়াদাহ-এর ভেতরে জিবরান প্রাচ্যের গোপন মহত্ত্বকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে মে ছিলেন প্রাচ্যদেশীয় নারীর প্রতিমূর্তি। যদি জিবরান মে-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁর অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতেন তাহলে তার সেই সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব সম্ভবত বাতাসে উবে যেত, বরং না-দেখা হওয়ার কারণেই মে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জিবরানের স্বপ্ন ও বাস্তবতার ভেতরে মিলেমিশে ছিলেন।
পাঠকের কাছে মে অবশ্যই একটা ধাঁধার মতো। জিবরান যতগুলি চিঠি লিখেছেন তার প্রায় অর্ধেক এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে মে এর প্রায় হাফডজন চিঠি একবার প্রকাশিত হয়েছিল এবং তা আরবিতে। বাকি চিঠিগুলি জনসমক্ষে প্রকাশিত হোক এটা তাঁর পরিবারের লোকেরা চায় না। সম্ভবত এমন সময় আসবে যখন সব চিঠিই আমাদের কাছে সহজপ্রাপ্য হবে।
ভাষান্তর প্রসঙ্গে
১
কহলীল জিবরানের নাম ও রচনার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে সত্তর দশকের শুরুতে। কোনো অগ্রজ কবি বা লেখক তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেননি। দিয়েছিল আমার বন্ধু কায়েস, সে জিবরানের ‘প্রফেট’ গ্রন্থটি নিউমার্কেট থেকে আমার জন্য চুরি করেছিল। তার ধারণা আমি সাহিত্যচর্চা করি, বইটি হয়তো আমার ভালো লাগবে। দীর্ঘ অতীন্দ্রিয়বাদী কবিতা প্রফেট, যেখানে দেখানো হয়েছে মানুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবনের দৃশ্য ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ধারণার প্রতিফলন–যেমন, বিয়ে, আইন, অপরাধ ও শাস্তি, স্বাধীনতা, উদারতা, ধর্ম, সৌন্দর্য এবং আনন্দ। যাহোক, কায়েসের দেখাদেখি আমিও একসময় বই চুরি করতে শুরু করি। কারণ ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি যে মেধাবী, জ্ঞানী ও পণ্ডিতেরাই সাধারণত বই চুরি করে–ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য কেউ বই চুরি করে না। সুতরাং বই চুরি কোনো অপরাধ নয়। আর এদিকে আমার প্রফেটগ্রন্থটা কে চুরি করেছে তার হদিসও পাই না অনেকদিন।