‘বিশাল যন্ত্রণার অর্থ হচ্ছে বিশাল শুদ্ধতা।’
৪
পৃথিবীর দুজায়গায় বসবাস করার পরও এই দুই লেবানীয়কে একত্রিত করেছিল যে প্রেম বন্ধন তা খুবই বিরলতম ঘটনা। এ সম্পর্ক শুরু হয়েছিল চিঠিপত্র লেখালেখির মাধ্যমে। তবে সনাতন পদ্ধতিতে এই প্রেম শুরু হলেও শুধুমাত্র চিঠিতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু তারা একে অন্যকে জানতেন বা চিনতেন শুধুমাত্র চিঠি বিনিময় ও পরস্পরের শিল্পকর্মের মাধ্যমে। কল্পনায় এবং স্বপ্নে ছাড়া তাদের কখনও সাক্ষাৎ ঘটেনি এবং এই প্রেমের ভেতর দিয়ে উভয়েই চিরস্থায়ী বাস্তবতা অনুসন্ধান করেছেন।
জিবরান এবং মে-এর পরস্পরকে লেখা প্রেমপত্রগুলি জিবরান-বিশেষজ্ঞদের কাছে এক মূল্যবান সম্পদ। সে কারণেই ১৯৫৯ সালে এ্যন্থেনি আর ফেরিজ প্রকাশ করেন কহলীল জিবরান : এ সেল্ফ পোর্ট্রেট এবং ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় ভার্জিনিয়া হিলু’র বিলাভেড প্রফেট; দ্য লাভ লেটার অব কহলীল জিবরান অ্যান্ড ম্যারি হাসকেল অ্যান্ড হার প্রাইভেট জার্নাল। জিবরানের অনুভূতির ছায়ার ওপর ফেলা এটা একটা নতুন আলো–এত খোলাখুলিভাবে কখনই নিজেকে ব্যাখ্যা করা হয়নি, যা চিঠিতে পাওয়া যায়। ম্যারি হাসকেলকে লেখা জিবরানের চিঠিগুলোও আবেগে পরিপূর্ণ। যদিও তিনি হাসকেলকে ভালোবাসতেন, তবুও তাদের সম্পর্ক ছিল পুরোপুরি অন্য প্রকৃতির। ম্যারি হাসকেলের ভেতরে তিনি শুধুমাত্র মাতৃত্বের প্রকাশই লক্ষ্য করেননি, কবি ও চিত্রশিল্পী হিসেবে চূড়ান্তভাবে তার আর্থিক ও নৈতিক সাহায্যের প্রয়োজনও জিবরান অনুভব করতেন। তবে তাদের সম্পর্ক ছিল মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক।
ম্যারি হাসকেল বা অন্যান্যদের সঙ্গে তার সম্পর্ক জিবরান যেভভাবে উপভোগ করেছেন, সেই তুলনায় মে জিয়াদাহ’র সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল সবদিক থেকেই একেবারে আলাদা। এ এমনই এক ভালোবাসা যা কোনো শ্রেণীতে বিভক্ত করা অসম্ভব, কারণ এটা ছিল আধ্যাত্মিক এবং নিষ্কাম ভালোবাসার উপাদানে পরিপূর্ণ। জিবরান এবং মে, একত্রিত হয়েছিলেন সুফিবাদের আকাঙ্ক্ষার ভেতরে এবং ঐশ্বরিক আত্মার কাছাকাছি যাওয়ার জন্য তারা সংগ্রাম করেছেন। জিবরানের চিঠিতে বারবার ‘নীল শিখা’র কথা বলা হয়েছে, যা তিনি মানুষের ভেতরে ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এই শিখাই মে-এর জন্য তার চিরস্থায়ী ভালোবাসার প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। এই দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা যোগ দিয়েছিলেন একটা আধ্যাত্মিক মিছিলে যে-মিছিলটা চলেছে সেই নীল শিখার প্রতি, যা কিনা বাস্তবতার শাশ্বত শিখা। এটা হচ্ছে তা-ই, জিবরান যাকে বলেছেন মে-এর জন্য আকাক্ষা। তার ভালোবাসা ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো শব্দের দরকার হয় না, কারণ তা। ছিল একটা অচঞ্চল প্রার্থনাসংগীত, যা রাতের নীরবতার ভেতরে শোনা যায় এবং সেখানে ধোঁয়াশা ও সবকিছুর জন্য রয়েছে নির্যাস।
লেবানীয় হিসেবে আমেরিকায় অভিবাসিত হয়ে জিবরান যে বিচ্ছিন্নতা বোধ ও বিচ্ছেদের কষ্ট ভোগ করেছেন তা ছিল একেবারেই শারীরিক ও মানসিক। তার আকাঙ্ক্ষা ছিল বিশ্বজনীন কর্মশক্তির সঙ্গে নিজের কর্মশক্তি ও জন্মস্থানের পুনর্মিলন ঘটানো, যেখান থেকে এগারো বছর বয়সে তার মূল উৎপাটন করা হয়েছিল। নিজের দেশে থাকার সময়ও তিনি একই বিচ্ছিন্নতাবোধের শিকার হন। আমেরিকায় তিনি নিজেকে দেখতেন একজন আগন্তুক হিসেবে এবং একটা চাকা হিসেবে যা অন্য চাকাগুলির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়–যা তাঁর প্রথম ইংরেজি রচনা দ্য ম্যাডম্যান-এর বর্ণনায় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের একমাত্র প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিই মুখোশটা সরিয়ে ফেলতে এবং সরাসরি বাস্তবতাকে দেখতে সক্ষম সেই ব্যক্তির মুখাবয়বে, যার সঙ্গীরা তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করেছে। জিবরানের আকাক্ষাও দ্বিধান্বিত হয়েছিল চূড়ান্ত বাস্তবতার স্থায়িত্বে, যার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল তার মাতৃভূমি লেবাননের জন্য কাতরতা। কিন্তু মে-এর ভেতরে তিনি এমন একজন ব্যক্তির সাক্ষাৎ পান সবকিছুতেই যার আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায় এবং জিবরানের আত্মা তার। পেছনেই ধাবিত হয়েছে।
জিবরান ও মে-এর ভেতরে চিঠি-লেখালেখি শুরু হয় ১৯১২ সালের দিকে এবং ১৯৩১ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে, যে-বছর জিবরান মারা যান। প্রথমদিকে বিশ শতকের আরবি সাহিত্যের এই দুই নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বের চিঠি লেখালেখি ছিল মূলত সাহিত্য বিষয়ক মতামত আদানপ্রদান, প্রশংসা ও সমালোচনা। জিবরানকে চিঠি লেখার আগে মে তাঁর রচনা ভালোভাবেই পড়েছিলেন। তিনি ১৯১২ সালে প্রকাশিত জিবরানের আরবি উপন্যাস দ্য ব্রোকেন উইংস সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জিবরানের স্টাইলের প্রশংসা করতেও ভোলেননি। উল্লেখ্য, উপন্যাসে সেলমা একজন বিবাহিত নারী, যে তার প্রার্থনার ভেতরে গোপন প্রেমিকের সঙ্গে মিলিত হয়। জিবরান অনুভব করেন যে, মানুষের আত্ম উপলব্ধির পথ থাকে ভালোবাসার ভেতরে। মে এসব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, কারণ তিনি প্রাচ্যদেশীয় নারী হিসেবে সমস্ত সামাজিক বাধানিষেধের আওতায় বসবাস করতেন এবং যা থেকে পালানোর কোনো উপায় তার ছিল না। তারপরও মে অন্য নারীদের উন্ধুদ্ধ করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতাকে সম্মান করতেন, কিন্তু তার নিজের সমাজের সূক্ষ্ম বন্ধনকে মোটেই আগ্রাহ্য করতে পারতেন না।