তিনি নিয়মিত প্রতিবেদক ছিলেন আল-মাহরওসাহ-এর এবং তাঁর সময়ের নেতৃস্থানীয় সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্রগুলিতে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হত। যেমন আল আহরাম, আল-হিলাল, আল-মুকাত্তাম, আল মুকতাতাফ। এছাড়াও ফরাসি পত্রিকা প্রোগ্রেস ইজিপশিয়ান এবং ইংরেজি ইজিপশিয়ান মেইল পত্রিকায়ও তিনি নিয়মিত লিখতেন। (ইংরেজিতে লেখার সময় আরও একটি ছদ্মনাম তিনি ব্যবহার করতেন তা হচ্ছে–রিফাত খালিদ)।
কহলীল জিবরানের রচনার ওপর সমালোচনা করার মাধ্যমে মে-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। তার প্রায় সবগুলি রচনায় জিবরানের চিন্তা ও স্টাইলের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়–যদিও তারা পরস্পরকে জানতেন শুধুমাত্র চিঠির মাধ্যমে। তাদের ভেতরে আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর সাহিত্যরুচির বিনিময় হত এবং গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। প্রেমকে যারা খুব অন্তরঙ্গভাবে উপভোগ করে সেইসব মানুষের ভেতরে সেই সাদৃশ্য এবং বোঝাবুঝি বিরল, যা তারা অর্জন করেছিলেন বলে মনে করতেন।
কায়রোতে তার বাড়ি পরিণত হয়েছিল মিশরীয় রাজধানীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সমাবেশ কেন্দ্রে। এই বাড়ি ছিল সবার মিলনস্থান। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তি এবং প্রাণবন্ত হৃদয়, যা ছিল তাঁর সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং তাঁর বিশাল আকর্ষণে তাঁর সময়ের নেতৃস্থানীয় লেখক–লুতফি সাইদি, ইয়াকুব সাররউফ, তাহা হুসেন, মুস্তাফা সাদেক আল রাফিই, ইসমাইল সাবরি, এডগার জাল্লাদ, এবং আব্বাস মাহমুদ আল আক্কাদ পর্যন্ত তাঁর প্রতি আকর্ষিত হয়েছিল। এদের অনেকের কাছে তিনি ছিলেন ‘শিল্পলক্ষ্মী’ এবং উৎসাহদাত্রী। তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব এবং বাকপটুতা ছিল অতুলনীয়–যা তিনি লিখেছেন তার চেয়েও।
মে জিয়াদাহ-এর আগ্রহ ছিল সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পাশাপাশি নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রতি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে নারীর ভোটাধিকারের জন্য হুদা সাহারাত্তই-এর নেতৃত্বে এই আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। মে তিন বছর (১৯১৫-১৯১৮) মিশরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে (কায়রোতে) লেখাপড়া করেন। এ সময়কালে হুদা সাহারাত্তই-এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয় তার এবং আন্দোলনে তার ভূমিকাকে তিনি নিশ্চিত করেন। মে, নারীমুক্তি আন্দোলনের পেছনেই তার জীবনটা ব্যয় করেছেন। বলতে গেলে জীবনের বেশি সময়ই উৎসর্গ করেছেন তিনি এই কাজে।
মে জিয়াদাহ ১৯২৭ সাল থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে তাঁর চারজন প্রিয় মানুষকে হারান; তাঁর পিতা-মাতা, বিশ্বস্ত বন্ধু ইয়াকুব সাররউফ এবং যাকে তিনি প্রকৃতই ভালোবাসতেন সেই কহলীল জিবরান। এতগুলি প্রিয় মানুষের মৃত্যুজনিত শোকে তিনি গভীরভাবে আক্রান্ত হন, যেমন তার চিঠিতে দেখা যায় :
‘এত যন্ত্রণায় আমি কখনও ভুগিনি-আমি কোনো বইতে পড়িনি যে, যন্ত্রণা মানুষের সহ্যক্ষমতার ভেতরেই থাকে, যার ভেতর দিয়ে আমি গেছি।’ [ডা, যোসেফ জিয়াদাকে লেখা চিঠি]
ফলে তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায় এবং তিনি দীর্ঘকালীন বিষণ্ণতার শিকার হন, যা অতিক্রম করতে তিনি ১৯৩২-১৯৩৪ সালের ভেতরে উন্মত্তের মতো ফ্রান্স, ইংল্যান্ড এবং ইটালি সফর করেন। ভ্রমণকালে তিনি বিদেশে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন–সে এক বিষণ্ণ ও করুণ কাহিনী। আত্মীয়স্বজনের তত্ত্বাবধানে লেবাননে ফেরার পর তাঁকে আজফাওরিয়াহ’ মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় তাঁর আংশিক মস্তিষ্কবিকৃতির লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করেন। তার বন্ধু আমিন রিহানি। তিনি আবার তাঁকে সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন এবং তার উৎসাহেই মে জিয়াদাহ ১৯৩৮ সালের ২২ মার্চ বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবের জীবনযাপন সম্পর্কে লেখকদের বাণী শীর্ষক এক বক্তৃতা দেন এবং তারপর থেকেই ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
লেবাননকে তিনি খুব ভালোবাসলেও তার হৃদয় পড়ে থাকত কায়রোতে। ১৯৩৯ সালের প্রথমদিকে তিনি কায়রোতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন এবং অল্পকিছু গুণগ্রাহী থাকা সত্ত্বেও নিঃসঙ্গ ও বন্ধুহীন অবস্থায় আড়াই বছর পর সেখানেই তিনি মারা যান।
তাঁর রচনাবলির ভেতরে রয়েছে বিভিন্ন গদ্যরচনা, প্রবন্ধ, আলোচনা, অনুবাদ, দুটি আত্মজৈবনিক রচনা, অল্পকিছু কবিতা, একটি সময়িক পত্রিকা এবং চিঠিপত্র। বিশ শতকের আরবি সাহিত্যে তার স্থান এখনও পুরোপুরিভাবে চিহ্নিত হয়নি, কিন্তু এটা সহজেই বলা যায়, প্রকৃতার্থে চিত্রকলার ওপর লেখাগুলোই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় কর্মকাণ্ড এবং বিশাল অর্জন। তিনিই বিশ শতকের আরবি সাহিত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহিলা গদ্যকার।
মে জিয়াদাহ-এর জীবন ও শিল্পকর্মকে পার্থক্য করা খুবই কঠিন। একজন কষ্ট-পাওয়া নারী এবং একজন উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীল মনের অধিকারী মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। যদিও শিল্পের সাধারণ ব্যাখ্যায় বলা যায় মে তার সময়ের ওয়ালি-উদদীন ইয়াকিন অথবা আব্বাস আল আক্কাদ-এর মতো মোটেও কোনো পেশাদার লেখক ছিলেন না এবং তিনি নির্ভর করতেন রচনার স্বতঃস্ফূর্ততা এবং শুদ্ধতার ওপর। তাঁর ক্লান্তিহীন জীবন, অভিজ্ঞতার জন্য আকাঙ্ক্ষা, প্রচলিত প্রথার প্রতি বিদ্রোহ, তার সময় ও তাঁর পরিপার্শ্বের জন্য ছিল একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলোর যন্ত্রণা ও কষ্টভোগের ভেতর দিয়ে তিনি এগোচ্ছিলেন আধ্যাত্মিক ম্রতা ও বাস্তবতার ভেতরের মর্ম উপলব্ধি করার শক্তির দিকে :