প্রথম পর্যায়ের সাহিত্যে জিবরানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যন্ত্রণা ও ভ্রান্তি দূর করার প্রবল চেতনাবোধ, জিবরানের প্রধান উদ্দেশ্য এখানে সমাজকে পুনর্গঠন করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি নারীর ওপর অবিচার করার জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন, যাজকদের অর্থলিপ্সার প্রবণতাকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন এবং বিদ্রোহ করেছেন কুসংস্কারপূর্ণ ও গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন সামাজিক বন্ধনের বিরুদ্ধে।
যাহোক, এসব প্রথমিক কাজ-কর্মের ভেতরে তাঁর পরবর্তীকালের রচনার উপকরণ ছিল। তিনি পুনর্বার দেহ ধারণের ধারণাসহ কাজ করেছেন যুগের ধুলো এবং অনন্ত আগুন নিয়ে এবং এই ধারণাই বছরের পর বছর তাঁর চিন্তায় তৈরি করেছে বিভিন্ন শক্তিশালী উপাদান। তারপরও তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বজনীন ভালোবাসার আরোগ্যকর শক্তি এবং অস্তিত্বের ঐক্য, যা তার আল আজনিহাল-মুতাকাসসিরা ও দামাহ ওয়া ইবতিসামাহ গ্রন্থে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরবি রচনায় জিবরান তার বিভিন্ন ধারণা ব্যাখ্যা করতে ছোট ছোট বর্ণনামূলক আখ্যান ব্যবহার করেছেন, কিন্তু এসব ছিল মূলত নীতিকথামূলক আখ্যানের প্রতিস্থাপন। শিক্ষামূলক রচনা, প্রবচন, প্রতীকাশ্রয়ী কাহিনী ও শ্লেষসমৃদ্ধ গদ্য কৌতুক এ সবই হচ্ছে জিবরানের ইংরেজি রচনার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক। কিন্তু আরবি ও ইংরেজি উভয় রচনাতেই তাঁর অদ্ভুত স্টাইল সালোমনের গান ও স্তুতিগীতির ইঙ্গিতবহ, এমনকি যিশুর উপদেশমূলক আখ্যানের তীব্র প্রতিধ্বনি–এ সবকিছুই প্রচণ্ড বাইবেলীয় প্রভাবের ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করলেও তাঁর রচনাকে দিয়েছে স্থায়িত্ব।
দ্য ম্যডম্যান (১৯১৮) প্রকাশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় জিবরানের সাহিত্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। এ পর্যায়ে প্রকাশিত অন্যান্য রচনাগুলি হচ্ছে : দ্য ফোররানার (১৯২০), দ্য প্রফেট (১৯২৩), স্যান্ড অ্যান্ড ফোম (১৯২৬), জেসাস, দ্য সান অব ম্যান (১৯২৮), দ্য আর্থ গর্ডস (১৯৩১), দ্য ওয়ান্ডারার (১৯৩২), এবং দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট (১৯৩৩)। শেষের গ্রন্থটি জিবরানের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। দ্য গর্ডেন অব দ্য প্রফেট লেখাটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়ে যায় যখন তিনি মারা যান। পরবর্তীকালে অন্য এক মার্কিনী কবি বারবারা ইয়ং বিক্ষিপ্ত পাণ্ডুলিপি একত্রিত করার পাশাপাশি নিজের কিছু শব্দ জিবরানের রচনায় যোগ করেছেন।
দ্য গার্ডেন অব দ্য প্রফেট সম্ভবত তাঁর ট্রিওলজি’র দ্বিতীয় গ্রন্থ, যা শুরু করেছিলেন প্রফেট দিয়ে এবং অলিখিত তৃতীয় গ্রন্থের পরিকল্পনা থেকে শুধু জানা যায় তৃতীয় গ্রন্থের শিরোনাম দিয়েছিলেন : দ্য ডেথ অব দ্য প্রফেট।
দ্বিতীয় পর্যায়ের সাহিত্য জীবনে জিবরানের ড্রইং-এর একটি সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। ১৯১৯ সালে টুয়েন্টি ড্রইং শিরোনামে এ্যলিস র্যাফেল-এর ভূমিকা সম্বলিত এই ছবির বইটিকে অনেকেই সেকালে জিবরানের শ্রেষ্ঠ কাজ বলে বিবেচনা করেন। তিনি ১৯০৫ সাল থেকে ছবি আঁকতে শুরু করেছেন এবং ১৯১৯ সালের আগেই তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। এই ছবির বইটি জিবরানের মরমী দক্ষতার গুরুত্ব বহন করে। এটা সেই দিক নির্দেশনার ওপর গুরুত্ব দেয় যা তিনি পেন্টিঙে, ড্রইঙে এবং লেখায় মেনে চলেছেন।
জিবরানের তথ্য বা বাণীর প্রচুর ব্যাখ্যা রয়েছে তার ইংরেজি রচনায়, বিশেষ করে প্রফেট গ্রন্থে, যেখানে দেখানো হয়েছে মানুষের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে জীবনের দৃশ্য এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ধারণার প্রতিফলন–যেমন বিয়ে, আইন, অপরাধ ও শাস্তি, স্বাধীনতা, উদারতা, ধর্ম, বেদনা এবং আনন্দ। তার দ্য প্রফেট গ্রন্থের বাণী আবেগজনিত বিশ্বাস হিসেবে সংক্ষেপিত হতে পারে এবং তা হল বিশ্বজনীন ভালোবাসার আরোগ্যকর শক্তি এবং অস্তিত্বের ঐক্য। তার মরমী প্রথা অনুসারে–জিবরান যা অনুসরণ করেন–সেই সমস্ত জিনিসের মূল চাবিকাঠি হল ভালোবাসা। এই ভালোবাসা যদি কারও থাকে তাহলে সে লোভ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক গর্ব, প্রথার প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তির ত্রাস থেকে মুক্ত হতে পারবে। ঐটাই হল দ্য আর্থ গডস-এর মূলভাব–একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত এই ভাব তাঁকে প্রভাবিত করেছে জেসাস, দ্য সান অব ম্যান-এর জেসাসের চরিত্রকে চিত্রায়িত করতে। এই ভাব আকার দিয়েছে ওয়ান্ডারার-এর নায়ককে–যা জিবরানের জীবনের সমস্ত বাণীকে স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে তোলে। সেইসঙ্গে দৃশ্যগুলো দখল করে মাতৃভূমি লেবাননের মনোভঙ্গি ও আবহাওয়ার পাশাপাশি মার্কিনীদের চিন্তার ধরন এবং ভাষাশৈলী, যা তিনি সফলভাবে রপ্ত করেছিলেন।
৩
মে জিয়াদাহ গত শতাব্দীর প্রথম তিন দশক ধরে আরবি সাহিত্যের মহিলা লেখক হিসেবে খ্যাত। তিনি লেবানীয় পিতা ও ইহুদি মাতার একমাত্র সন্তান। পিতার নাম ইলিয়াস জাখুর জিয়াদাহ এবং মায়ের নাম নুজহা কহলীল মুমার। মে জিয়াদাহ-এর জন্মতারিখ ১৮৮৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, স্থান প্যালেস্টাইনের নাজারেত। জন্মস্থানেই তার লেখাপড়া শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে পাঁচ বছরের জন্য লেবাননে আইনতোওরাহ ইনসটিটিউটে লেখাপড়া করেন। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠানে শুধু মেয়েরাই লেখাপড়া করে। ১৯০৮ সালে তাঁর শিক্ষক পিতা মিশরে শিক্ষকতার অধিক সম্ভাবনা দেখে পরিবারসহ কায়রোতে চলে আসেন এবং শিক্ষকতা পেশায় না গিয়ে তিনি আল-মাহরওসাহ নামে একটা দৈনিক সংবাদপত্রের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নিযুক্ত হন। তখন কায়রো ছিল শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমি, ফলে মে জিয়াদাহ-এর বয়স কুড়ি হওয়ার আগেই এসব কর্মকাণ্ড তাঁর আগ্রহকে উদ্দীপিত এবং উৎসাহিত করে এবং এই উৎসাহের ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে তাঁর প্রথম সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়–শিরোনাম : ফ্লেউরস দ্য রেভি। ফরাসি ভাষায় লেখা আইসিসকোপিয়া ছদ্মনামের এই প্রাথমিক কাজে শুধুমাত্র ফরাসি প্রভাবই নয়, বিশেষ করে ফরাসি লেখক ও কূটনীতিক লা মার্টিনির প্রভাব প্রচুর পরিমাণে লক্ষ্য করা। যায়। এমনকি তার অদ্ভুত, উদ্ভাবক ও সৃষ্টিশীল মনকেও মে নিজের ভেতরে ধারণ করেছিলেন।